ধর্মীয় দর্শন ডেস্কঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর পৃথিবীতে মসজিদসমূহ শ্রেষ্ঠতর স্থান। যেখানে মুমিন বান্দাগণ নামায আদায় করে, তাঁর নিকট প্রার্থনা করে, যিকর -আয্কার করে, কুরআন তিলাওয়াত করে এবং আরো অন্যান্য ইবাদত করে।
এই পবিত্র ঘরে প্রবেশ, বের হওয়া এবং তাতে অবস্থান করার বিষয়ে শরীয়তে কিছু আদব বর্ণিত হয়েছে, যা বর্তমানে অনেকে উপেক্ষা করে থাকে। তাই এই বিষয়ে শরীয়তে বর্ণিত আদবসমূহ খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
১. প্রবেশের সময় ডান পা আগে রেখে প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার সময় বাম পা আগে রেখে বের হওয়া। কারণ সাহাবী ইবনে উমার (রাযিঃ) এইরূপ করতেন এবং নবী (সাঃ) এর সম্পর্কে আয়েশা (রাযিঃ) বলেনঃ ‘‘ তিনি (সাঃ) পারতপক্ষে সব কাজ ডান দিক হতে করা পছন্দ করতেন’’। [ বুখারী মুসলিম]
২. প্রবেশকালে মসজিদে প্রবেশের দুআ’ পড়া, আর তা হচ্ছে, ‘‘বিস্মিল্লাহি ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ্ তাহ্লী আব্ ওয়াবা রাহ্ মাতিক্’’। অর্থঃ ‘ আল্লাহর নামে (প্রবেশ করছি), দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী (সাঃ) এর প্রতি। হে আল্লাহ! আমার জন্য তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও’।
অনুরূপ বের হওয়ার সময় দুআ’ পাঠ করা। আর তা হছে, ‘‘বিস্মিল্লাহি ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্, আল্লাহুম্মা ইন্নী আস্ আলুকা মিন্ ফায্লিক্’’। অর্থঃ ‘ আল্লাহর নামে বের হচ্ছি), দরূদ ও সালাম হোক নবী (সাঃ) এর প্রতি, হে আল্লাহ ! আমি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি’’।[ মুসলিম, এবং ইবনু মাজাহ, সহীহ আল্ জামে নং৫১৪]
৩. মসজিদে প্রবেশের সময় শান্তি ও ধৈর্য বজায় রাখা। হযরত আবু কাতাদাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা আমরা নবী (সাঃ)-এর সাথে নামায আদায় করছিলাম ,এমন সময় শোরগোল শোনা গেল। নামায শেষে নবী (সাঃ) বললেনঃ ( তোমাদের কী হয়েছে?) তারা বললোঃ নামাযের জন্য তাড়াহুড়ো করছিলাম। নবী (সাঃ) বলেনঃ
‘‘এমন করো না; যখন নামাযে আসবে, তখন শান্তভাবে আসো; যা পাবে তা পড়ে নেবে , আর যা ছুটে যাবে তা পূরণ করে নেবে ’’। [ বুখারী]
৪. মসজিদে প্রবেশের পর দুই রাকাআ’ত তাহিয়্যাতুল্ মসজিদ নামায আদায় করার পূর্বে না বসা। নবী (সাঃ) বলেন
‘‘ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন সে যেন না বসে যতক্ষণে দুই রাকাআ’ত নামায না পড়ে’’। [ বুখারী)
৫. একা একা নামায পাঠকারী হলে এবং তার সামনে কিছু না থাকলে সে যেন সুতরা করে নেয়।( সুতরা এমন বস্তুকে বলা হয় যা নামাযী তার সম্মুখে রাখে, যেন তার সামনে দিয়ে কেউ না যায়)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি নবী (সাঃ) কে বলতে শুনেছেনঃ ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোন কিছুর সামনে নামায পড়ে, যা লোকদের আড় করে দেয়, অতঃপর কেউ যখন (নামাযী ও আড়কারী বস্তুর) মাঝ দিয়ে যেতে চায়, তখন সে যেন তাকে বাধা দেয়, যদি সে না মানে, তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে; কারণ সে শয়তান’’। [বুখারী , মুসলিম]
৬. আযানের পর কারণ ব্যতীত যেন কেউ মসজিদ থেকে বের না হয়। আবুশ্ শা’শা’ হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমরা আবু হুরাইরার সাথে মসজিদে বসেছিলাম, অতঃপর মুআয্যিন আযান দিল। তারপর এক ব্যক্তি উঠে বেরিয়ে যেতে লাগলো। অতঃপর আবু হুরাইরা (রাযিঃ) তার দিকে চেয়ে থাকলেন, যতক্ষণে সে মসজিদ থেকে বের না হলো। তারপর তিনি বললেনঃ ‘‘ এই ব্যক্তি আবুল কাসিম ( নবী সাঃ) এর অমান্য করলো। [মুসলিম ]
৭. কোন লোক যখন দেরিতে মসজিদে আসে, তখন সে যেন শেষের লোকেরা যেখানে স্থান পেয়েছে সেখানে বসে এবং লোকের ঘাড় না ডিঙ্গায়। আর না বসে থাকা দুই ব্যক্তির মাঝে ফাঁক করে আর না অন্যকে তার স্থান থেকে উঠিয়ে সেখানে বসে। বিশেষ করে জুমআর দিনে যেন এমন না করে কারণ হাদীসে উল্লেখ হয়েছে, এক ব্যক্তি জুমআর দিনে লোকদের ঘাড় ডিঙ্গালে নবী (সাঃ) তাকে বললেনঃ
‘‘ বসো কারণ তুমি অন্যকে কষ্ট দিলে’’। [আবু দাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ]
৮. মসজিদে যাবার পূর্বে দুর্গন্ধ খাবার না খাওয়া, যেমন কাঁচা পেয়াজ, কাঁচা রসুন, বিড়ি, তামাক এবং এ জাতীয় বস্তু যা খেলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। নবী (সাঃ) বলেনেঃ ‘‘ যে ব্যক্তি এই খবীস (মন্দ) চারা গাছের কিছু খেল, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটে না আসে। কারণ ফেরেশ্তাগণ কষ্ট পান তা দ্বারা, যা দ্বারা আদম সন্তান কষ্ট পায়’’। [সহীহ আল্ জামে হাদীস নং ৬০৯১]
৯. মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মসজিদের জিনিস-পত্রের হেফাজত করা । আবু যর (রাযিঃ) নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘‘ আমার উপর আমার উম্মতের নেক কাজ এবং গুনাহর কাজ পেশ করা হয়। আমি তাদের সৎ আমলে পেলাম কষ্টদায়ক বস্তু , যা রাস্তা হতে সরানো হয় এবং তাদের পাপ আমলে পেলাম নাকের নোংরা (ময়লা) যা মসজিদে থাকে তা পরিষ্কার করা হয় না’’। [ মুসলিম]
১০. প্রত্যেক এমন কাজ না করা, যা মসজিদের আদব বহির্ভূত; যেমন ক্রয়-বিক্রয় করা, হারানো বস্তু খোঁজা এবং এইরূপ আরো অন্য কিছু। আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেনঃ
‘’ যদি তোমরা কাউকে মসজিদে কোন কিছু বিক্রি কিংবা খরিদ করতে দেখ, তাহলে বলঃ আল্লাহ যেন তোমার ব্যবসায় লাভ না দেন। আর যদি কাউকে সেখানে হারানো বস্তু খুঁজতে দেখ, তাহলে বলঃ আল্লাহ যেন তোমাকে তা ফিরিয়ে না দেন’’। [ তিরমিযী, সহীহ তারগীব ও তারহীব নং ২৯১]
১১. মসজিদে খেল-তামাশা, অনর্থক দুনিয়াবী কথা-বার্তা এবং উঁচু শব্দে এমনভাবে কুরআনের তিলাওয়াত না করা, যার কারণে অন্যান্য নামাযী, যিকিরকারী এবং মসজিদে দ্বীনের শিক্ষা প্রদানকারীদের কষ্ট হয়। ‘‘ সাইব বিন ইয়াযীদ সাহাবী বলেনঃ একদা আমি মসজিদে ছিলাম, অতঃপর এক ব্যক্তি আমাকে নাড়া দেয়, তাকিয়ে দেখিঃ তিনি ছিলেন উমার বিন্ খাত্তাব (রা)। তিনি আমাকে বললেনঃ যাও ঐ দুই ব্যক্তিকে আমার নিকট নিয়ে আসো, আমি তাদের নিয়ে আসলাম। তিনি তাদের বললেনঃ তোমরা কোথাকার? তারা বললোঃ তায়েফ বাসী। তখন তিনি বললেনঃ যদি তোমরা এই শহরবাসী হতে তো তোমাদের দুইজনকে শাস্তি দিতাম। রাসূল (সাঃ) এর মসজিদে তোমরা উঁচু আওয়াজে কথা বলছো!’’ [বুখারী]
অন্য এক হাদীসে এসেছে, নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘ সতর্ক! তোমরা প্রত্যেকে তার প্রভূর সাথে সংগোপনে আলাপকারী (মুনাজাতকারী), তাই যেন কেউ অন্য কাউকে কষ্ট না দেয় আর না তেলাওয়াত কালে এক অপরের উপর আওয়াজ উঁচু করে’’। [ নাসাঈ ]
১২. নামাযের সময় মসজিদে লাইন সোজা করা এবং লাইনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। নবী (সাঃ) স্বয়ং লাইন সোজা করতেন এবং বলতেনঃ ‘‘ বরাবর হয়ে যাও, ভিন্ন ভিন্ন হয়ো না; নচেৎ আল্লাহ তোমাদের অন্তরকে ভিন্ন ভিন্ন করে দিবেন, বড় ও জ্ঞানীরা যেন আমার নিকটে থাকে’’ [ মুসলিম]
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেনঃ ”
‘‘তোমরা নিজের লাইনগুলি সোজা করে নিবে ; কারণ লাইন সোজা হওয়া পূর্ণাঙ্গ নামাযের পরিচয়’’। [ মুসলিম]
১৩. মসজিদে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দুআ-প্রার্থনা না করা। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ ( এবং অবশ্যই মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্যে। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না।) [ সূরা জিন: ১৮]
১৪. মসজিদে মাইয়্যেত দাফন না করা। নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘ ইহূদী ও খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ হোক, তারা তাদের নবীগণের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়েছে’’। [ বুখারী মুসলিম]
নবী (সাঃ) মসজিদে নববী নির্মাণের সময় মসজিদের স্থানে পুরাতন কবরগুলি স্থানান্তর করেন।
আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে তাঁর ঘরের সকল আদব রক্ষা করে চলার তাওফীক দান করেন । আমীন !!!
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই