আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বব্যাপী ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে প্রতি বছরের এই দিনে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
অভিবাসী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য, অভিবাসীর অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায় বিচার।
১৯৯০ সালে অভিবাসী শ্রমিক ও দেশে ফেলে আসা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে জাতিসংঘ। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮ ডিসেম্বরকে লক্ষ্য করে মাইগ্রেন্ট রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটসসহ বিশ্বের অনেক সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বৈশ্বিকভাবে প্রচারণা চালায়। ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারণার ফলে ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক চু্ক্তি-৪৫/১৫৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে এবং ১৮ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে আমি কুয়েত প্রবাসীদের জীবনযাপনের কিছু বাস্তবচিত্র ও তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কিছু বাস্তবতা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
কুয়েতে মৃত্যুর মিছিলে একের পর এক যোগ হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশী, প্রতি সপ্তাহে ২ থেকে ৩জন প্রবাসী অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমবেশি সব দেশেই হচ্ছে।
তবে ২০১৮ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েতে যে হারে প্রবাসীদের মৃত্যু হচ্ছে; তাতে স্পষ্ট একটি পরিসংখ্যান, বহির্বিশ্বে প্রবাসী মৃত্যুর রেকর্ডে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে কুয়েতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিকট অতীতের অধিক মৃত্যুর রেকর্ডটি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন কারণে ২১৭ জন কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে আরো জানা গেছে, ২০১৮ সালের এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক কুয়েত প্রবাসী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন।
পরিস্থিতি যখন এহেন অমানবিক, ঠিক তখন সর্বমহলে একটি প্রশ্ন জেগেছে যে, কেন? কী কারণে? সংখ্যাধিক প্রবাসীদের মৃত্যু হচ্ছে বিদেশের মাটিতে।
এমতাবস্থায় প্রবাসীদের মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট একটি কারণ উদঘাটন করতে অগ্রদৃষ্টি পরিবার কাজ শুরু করেছে কুয়েতে।
৩ থেকে ৪ বছর আগে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, অতিরিক্ত অভিবাসন খরচই বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রধান কারণ বলে মনে করেন বর্তমান সরকার তাই অভিবাসন খরচ কমাতে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
মন্ত্রী তখন আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি টাকা খরচ করে একজন শ্রমিক বিদেশে যান। এরপর সেই খরচ তোলার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ফলে কর্মক্ষেত্রে তাঁরা অমানুষিক পরিশ্রম করেন। এ ছাড়া কর্মীরা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করেন। এসব কারণে শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। অত্যধিক পরিশ্রম ও মানসিক চাপে কর্মীদের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে অনেক সময় অল্পবয়সী শ্রমিকেরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার অস্বাভাবিক অভিবাসন খরচ কমাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় এখন মাত্র ৩২ হাজার টাকায় কর্মী যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য দেশেও কম খরচে শ্রমিক পাঠানো হবে।’
নিঃসংকোচে বলা যায়, তখনকার মন্ত্রী মহোদয় কিছু যুগোপযুগি বিষয় উপস্থাপন করেছিলেন; যেটি আসলে’ই বাস্তবতার সাথে অনেকটাই মিল ছিল।
কিন্তু কোথায় সেই প্রবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ? কোথায় সেই সল্প খরচে শ্রমিক প্রেরণ? কোথায় সত্যিকার অর্থে প্রবাসীদের কল্যাণে কিঞ্চিৎ কর্মের চিহ্ন কিংবা প্রবাসীদের মৃত্যু রোধকল্পে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ?
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো প্রবাসীদের মৃত্যুর এই হার নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটটি লাশ আসা অসম্ভব কিছু নয়।
এদিকে অগ্রদৃষ্টির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে যাঁদের লাশ আসছে, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এঁদের ৩০ শতাংশ মারা গেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে। অন্যরা হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যানসার, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। গত দুই বছরে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রবাসী বাংলাদেশি, মৃতদের স্বজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত পাঁচটি কারণে বাংলাদেশিরা স্ট্রোক বা হূদেরাগের মতো সমস্যায় পড়েন। এগুলো হলো প্রতিকূল পরিবেশ, যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম এবং একই সঙ্গে বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তা, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো ঘটনা ঘটছে।
দীর্ঘদিন কুয়েত সাবাহ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন আহমদ জাবের খালেদ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড গরম। এখানে তাপমাত্রা ৫০ থেকে ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত থাকে।মূলত শ্রমিকেরা যে পরিবেশে এখানে কাজ করছেন, সেটা অমানবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রম আইন মানা হয় না। আবার তাঁরা এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকেন। সেখানে অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান।’ তিনি মনে করেন, কাজের পরিবেশ বা থাকার পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া এই মৃত্যু বন্ধের কোনো উপায় নেই।
গত ছয় বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১৮ হাজার প্রবাসীরা দেশে লাশ হয়ে ফিরেছেন।
আর এই ৬বছরে কুয়েত থেকে প্রায় এক হাজার প্রবাসীরা লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন।
কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মিজানুর রহমানের দেয়া তথ্য মোতাবেক কুয়েতে প্রতি মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৩জন প্রবাসীদের আকস্মিক মৃত্যু হচ্ছে।
অভিবাসী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য, অভিবাসীর অধিকার, মর্যাদা ও ন্যায় বিচার।
এ সম্পর্কে বলবো, প্রবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো আমরা পিছিয়ে রয়েছি, মর্যাদার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের উদ্যোগেই যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, সেটি নিঃসংকোচে স্বীকার করতেই হবে।
তবে প্রবাসীরা যাদের কারণে সমস্যাগ্রস্ত হচ্ছেন, এই বিষয়ে ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খানিকটা ব্যর্থতাও রয়েছে।
আ হ জুবেদ
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী