অগ্রদৃষ্টি বিশেষ প্রতিবেদনঃ মহাষ্টমীতে বুধবার দুর্গতিনাশিনী দেবীর পায়ে অঞ্জলি দিয়েছেন ভক্তরা। করেছেন মায়ের বন্দনা। মহাধুমধামে উৎসবের উন্মাদনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাষ্টমী পূজা পালিত হয়েছে। প্রতিবারের মতো মহাষ্টমী পূজার মূল আকর্ষণ ছিল দেশের সব রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কুমারী পূজা। স্বামী বিবেকানন্দ কুমারীকে দেবী ভগবতী ও মা সারদাদেবীর ষোড়শীরূপে পূজা করার যে প্রচলন করে গেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় আজও মিশনে মিশনে হচ্ছে এই পূজা। এবারও কুমারী পূজার বর্ণাঢ্য আয়োজন ছিল রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন পূজামণ্ডপে। ভোর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হতে থাকেন রামকৃষ্ণ মিশনসহ বিভিন্ন মণ্ডপে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডপগুলোতে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে।
বেলা সাড়ে ১১টায় কুমারী দেবীকে আসনে বসানো হয়। হাজারো ভক্ত দেবীদুর্গা ও কুমারী মাকে জয়ধ্বনি, উলুধ্বনি, শাঁখ, শঙ্খ, ঢাকঢোল ও কাঁসরের ধ্বনির মধ্য দিয়ে বরণ করে নেন। এবার কুমারী দেবীরূপে মণ্ডপে অধিষ্ঠিত হন কিশোরী প্রণীতা উষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কুমারীর শাস্ত্রীয় নাম এক এক বয়সে এক এক রকম। যেমন এক বছরে সন্ধ্যা, ২ বছরে সরস্বতী, ৩ বছরে ত্রিধামূর্তি, ৪ বছরে কালিকা, ৫৪ বছরে সুভগা, ৬ বছরে উমা ও ৭ বছরের কিশোরীর নাম হয় ‘মালিনী’। এই প্রণীতা তথা মালিনীর তার জন্ম ২০০৯ সালের ১০ জুন। বাবার নাম প্রিয়শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মায়ের নাম গায়ত্রী ভট্টাচার্য। সে সেন্ট ফ্রান্সিস জোভিয়ার্স কিন্ডারগার্টেনের লোয়ার কেজি শ্রেণীর ছাত্রী। সকালে কুমারী প্রণীতা উষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। মাথা ও গলায় ফুলের মালা, অলংকার ও প্রসাধনে নিপুণ সাজে সাজিয়ে তোলা হয় তাকে। এরপরই কুমারী মাকে মন্ত্র পাঠ করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শরীর-মন শুদ্ধ করে মাতৃজ্ঞানরূপে পূজা করা হয়। ১৬টি উপকরণ দিয়ে কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস- এ পাঁচটি উপকরণ দিয়ে কুমারীকে পূজা করা হয়। কুমারী পূজা পরিচালনা করেন কল্যাণ মহারাজ। তন্ত্রধারক ছিলেন স্বামী স্থিরানান্দ। কুমারী পূজা শেষে ভক্তরা মাকে প্রণাম করেন। পরে দুর্গাপূজার অঞ্জলি প্রদান করা হয়। অঞ্জলি প্রদান শেষে হাজার হাজার ভক্ত-দর্শনার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় মহাপ্রসাদ।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮ সালে কাস্মিরের ক্ষীরভবানী মন্দিরের দেবীপীঠে সর্বপ্রথম কুমারী পূজার আয়োজন করেন। যোগিনীতন্ত্র মতে আদিকালেও কুমারী পূজার প্রচলন ছিল। কলকাতার বেলুড় মাঠে ১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচারক স্বামিজী শারদীয় দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে ৯ জন কুমারীকে সাজিয়ে মাতৃরূপেনু দুর্গোতিনাশিনী দেবীকে পূজা করেন। সেই থেকে কুমারী পূজার প্রচলন বাঙালি হিন্দু সমাজে পালিত হয়ে আসছে। কুমারী পূজা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশে প্রকাশ। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূতপবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন। প্রত্যেকে শ্রদ্ধাশীল হবে নারী জাতির প্রতি।
সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে রামকৃষ্ণ মিশনে শুরু হয় মহাষ্টমী পূজা। অষ্টমী পূজা ছাড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে সন্ধিপূজা। অষ্টমীর শেষ নবমীর শুরুর সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হয় সন্ধিপূজা। যেসব মণ্ডপে কুমারী পূজা হয়, সেখানে একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনটি পূজা। দিনের বেলা অষ্টমী বিহিত পূজা আর কুমারী পূজা পরে সন্ধিপূজা।
আজ মহানবমী কাল বিজয়া দশমী : আজ সারা দেশে মহাধুমধামে শুরু হবে মহানবমী পূজা। পূজা শুরু হবে ৬টা ৩০ মিনিটে। আগামীকাল শুক্রবার হবে বিজয়া দশমী ও বিসর্জন। সারা দেশেই শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। বিজয়া দশমীকে সামনে রেখে দশভুজা দুর্গার আরাধনার পাশাপাশি দেবীকে বিদায় জানানোর আয়োজনে ভক্তকুল থাকবেন বিষণ্ণ ও অশ্রুসজল। আজ মণ্ডপে মণ্ডপে প্রধান আকর্ষণ থাকবে আরতি প্রতিযোগিতা। রাতকে উজ্জ্বল করে ভক্তরা মেতে উঠবেন নানা ঢঙে আরতি নিবেদনে। একই সঙ্গে দিনভর চলবে চণ্ডীপাঠ। থাকবে ভক্তদের কীর্তনবন্দনা। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে আজ স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন পূজানুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন পূজামণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে ভক্তিমূলক সঙ্গীতানুষ্ঠান, অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও সন্ধ্যায় ভোগ আরতি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি এখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন সমগ্র বাঙালির অংশগ্রহণের এক মিলনমেলা। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শারদ উৎসবে সব ধর্মাবলম্বী শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করছেন।
বুধবার দুপুরের দিকে ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকায় গিয়েও দেখা যায় সেখানে অসম্ভব ভিড়। তবে এখানকার বাড়তি পাওনা হচ্ছে পুজোর পাশাপাশি মেলাও বসেছে। একদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে ও উলুধ্বনি দিয়ে ভক্তরা যেমন ভক্তি প্রকাশ করছেন, ঠিক তেমনি আরেক দিকে শিশুসহ নানা বয়সীরা মেলা থেকে মিঠাইমণ্ডা, লাড্ডু, বাতাসা, নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা জিনিস কিনছেন অনেকেই। পাশেই আছে নাগরদোলা, সেখানেও শিশুদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের যেন কমতি নেই। বিভিন্ন মন্দির ঘুরে আরও দেখা গেল নানা রঙের আলোকসজ্জা আর চমৎকার সব তোরণ। মেলা বসেছে রমনা কালী মন্দির, ধানমণ্ডির কলাবাগান, শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির এবং পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকায়। এসব এলাকায় এখন বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণী-পেশার মানুষের আনাগোনা। পুজো আর প্রতিমা দেখার পাশাপাশি নানা পণ্যের বিকিকিনিও চলছে দেদারসে। ধুমসে চলছে শাঁখারিবাজারে শাঁখারিদের তৈরি বালা, শঙ্খ, সাজসজ্জার উপকরণের বিক্রিও।
বাসাবোর শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে দেখা গেল অন্য এক চিত্র। সেখানকার উৎসব আয়োজকরা এবার প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক আয়োজনও করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় সেখানে মঞ্চায়িত হয় নাটক ‘কোকিলারা’। আবদুল্লাহ আল মামুনের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটি পুনঃনির্মাণ করেছেন সুদীপ চক্রবর্তী। একক অভিনয় করেছেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। শারদীয় উৎসবে এই ধরনের মঞ্চ নাটক প্রদর্শন এবারই প্রথম। নাটক দেখতে সন্ধ্যায় হাজারও মানুষের ভিড় পরিলক্ষিত হয় সেখানে। এছাড়া বিরাট দীঘির পাশে বসেছে মেলাও। সেখানে মিষ্টি দোকান, নানা কুটির শিল্পের বিকিকিনি এবং সার্কাস প্রদর্শন করা হচ্ছে।