জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া : বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত অনেক অপরাধীর ফাসিঁও হয়েছে । তবু অনেক শহীদ পরিবারের মাঝে এখনো একরাশ হতাশা বিরাজ করছে । চরম উপেক্ষা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন অনেক শহীদের পরিবার। তেমনি চরম অবহেলা ও অমর্যাদায় পড়ে আছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরায় একাত্তরের ১৩ শহীদের গণকবর । এ অমর্যদা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধকেই উপহাস করেছে। দীর্ঘ ৪৪ বছর পরেও জীবন্ত কবরস্থ হওয়া সেই মহান ১৩ শহীদের আতœত্যাগের কোন মূল্যায়ন নেই। সরকারি, বেসরকারি কোন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাজনৈতিক দলগুলোও এই গণকবরটির প্রতি সম্মান জানানো কিংবা সংরক্ষণ করার প্রয়োজনবোধ করেনি এতো দিনেও। স্বাধীন ভুখন্ড আর লালসবুজ পতাকা নিয়ে গর্বিত জাতি। কিন্তু যাদের আতœত্যাগের বিনিময়ে এ গৌরবময় বিজয় তাদের স্মরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে না কেউ। ক্ষমতার পালাবদল হয়, সভা সমাবেশে চলে উন্নয়নের জোয়ার নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা। কিন্তু বার বার উপেক্ষিত থেকে যায় শহীদদের আতœত্যাগ। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কস্থ রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা চৌমুহনী। এই চৌমুহনীর মাত্র ৫০ গজ দূরে সড়কের দক্ষিণ দিকে পোমরা বনবিটের পাশেই বর্তমান বাচাশাহ নগরে এই ঐতিহাসিক পোমরা গণকবরটি। স্থানটি এখন ঘাস, লতাপাতা, গাছ-গাছালিতে পূর্ণ। এখানে বন্য পরিবেশ ছাড়া কিছুই নেই। অথচ সামান্য ব্যয়ে ঐতিহাসিক স্থানটিকে চির অম্লান করে রাখা যায়। সামান্য কাজটি করার জন্য যেন কেউ নেই। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক গণকবরটি সংরক্ষণ করা হলে দর্শনীয় স্থান ছাড়াও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে নবপ্রজন্ম দারুনভাবে উজ্জীবিত হবে গৌরবময় ইতিহাস সংরক্ষনের। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। পাকবাহিনীর ৫০-৬০ জনের দলটি পোমরা শান্তির হাটের উত্তর দিকে মধুরাম তালুকদার পাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু পল্ল¬ীটির ওপর। নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর, পৌঁঢ়, বৃদ্ধদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায পশুর দলটি। এক পর্যায়ে পাড়ার মাত্র ৭ দিনের এক কন্যা শিশু যার নাম রাখা হয়েছিল যুদ্ধবতী। তাকে দোলনা থেকে মাটিতে ফেলে রেখে দোলনার রশি খুলে সে রশি দিয়ে একে একে ১৮ পুরুষকে বেধে ফেলে। তারপর সবাইকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পোমরা বনবিটের সামনে তাদের আস্তানায়। আবার পথে সকলকে গামছা ও অন্যান্য কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে আনা হয় গরু পেটানোর মত করেই। তাদের পরিণতি ও নির্মমতার কথা ভেবে শত শত নারী পরুুষ পাক হানাদারদের পা জড়িয়ে ধরেও শেষ রক্ষ করতে পারেনি। ১৮ জনের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে ৫ জনকে আধামরা করে ছেড়ে দিয়েছিল পাকবাহিনী। যে ৫ জন তখন ছাড়া পেয়েছিলেন তারা হচ্ছেন অশ্বীনি দাশ, হরেকৃষ্ণ দাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ এবং হরিকৃষ্ট দাশ। তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। বাকি ১৩ জনকে পোমরা বনবিটের পেছনে তাদের দিয়েই একটি বিশাল গর্ত খুঁড়ে জীবন্ত কবর দিয়ে দেয় নরপশুরা। যে ১৩ জনের জীবন্তু সমাধি হয়েছে তারা হচ্ছেন মন্টু আইচ, গান্ধি দাশ, রমণী দাশ, হরিপদ দাশ, জগৎ চন্দ্র দাশ, বাবুল দাশ, বিরাজ দে, বোচা দেব, ফকির চাঁদ দাশ, দুলাল দাশ ও চয়ন দাশ এরা সবাই তখন যুবক ও পৌঢ়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম মজুমদার বলেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় কয়েকটি ৭১ এর গণকবর থাকলেও তা চিহ্নিত করা হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার গণকবর চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
তিনি বলেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা বাচাশাহ্ নগর এলাকায় এবং মরিয়মনগর পূর্ব সৈয়দবাড়ী বড় হুজুরের দিঘীর দক্ষিণ পূর্ব পাড়ে গণকবর দুটি চিহ্নিত করে সার্ভে করার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধারে সম্মানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ শিক্ষামূলক নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। শীঘ্রই কাজ শুরু হচ্ছে ।