যখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর তখন সুইমিং পুলে এক দুর্ঘটনার পর থেকে চোখে দেখতে পাননা চিয়েকো আসাকাওয়া। কিন্তু অন্ধত্ব থামিয়ে দিতে পারেনি তার অদম্য ইচ্ছাকে। গত দশক ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে।
বর্তমানে তার মনোযোগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত উদ্ভাবনে, উদ্দেশ্য দৃষ্টি-শক্তিহীন মানুষদের জীবনের রূপান্তর ঘটানো।
“যখন আমি কাজ শুরু করেছিলাম তখন সহায়ক কোনধরনের প্রযুক্তি ছিলনা”, বলছিলেন ডক্টর আসাকাওয়া।
তার নিজের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। “কোন তথ্যই আমি নিজে পড়তে পারতাম না। আমি একা কোথাও যেতে পারতাম না”।
এইসব কষ্টের অভিজ্ঞতা তার শেখার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তিনি অন্ধদের জন্য নির্ধারিত কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ক একটি কোর্সে অংশ নেন। তারপর আইবিএম-এ একটি চাকরিও পেয়ে যান। কাজের সাথে সাথে সেসময় ডক্টরেট করার জন্য একইসঙ্গে তার লড়াই চলতে থাকে।
প্রাথমিক ডিজিটাল ব্রেইল উদ্ভাবনের পেছনে ডক্টর আসাকাওয়ার অবদান রয়েছে। তিনি বিশ্বের প্রথম ব্যবহারিক ওয়েব টু স্পিচ ব্রাউজার তৈরি করেন। এখন তা অহরহ দেখা গেলেও ২০ বছর আগে জাপানের অন্ধ মানুষদের ইন্টারনেটে আরও তথ্যের সুযোগ করে দেন যা তাদের আগে ছিলনা।
এখন তিনি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিবিদরা মিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দৃষ্টিহীণ ব্যক্তিদের জন্য টুলস তৈরি করতে চান।
ডক্টর আসাকাওয়া নাভকগ নামের ভয়েস কন্টো্রল্ড স্মার্ট-ফোন অ্যাপ তৈরি করেন যা অন্ধ ব্যক্তিদের জটিল ইনডোর লোকেশন নেভিগেট করতে সহায়তা করে থাকে।
বর্তমানে প্রচলিত ইন্টারনেট ম্যাপ যেমন গুগল ম্যাপের ‘ইনডোর লোকেশন’ বিষয়ে কোন সুবিধা নেই এবং পুরোপুরি অন্ধ বা দৃষ্টিশক্তি লোকেদের বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনা।
ফলে এর চেয়ে বিশদ পরিসরে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক ডাটা সংগ্রহের মাধ্যমে।
“এটা খুব সহায়ক হতে পারে কিন্তু এটা সঠিকভাবে নেভিগেট করতে পারে না” বলেন ডক্টর আসাকাওয়া। তিনি এখন একজন আইবিএম ফেলো, যারা এমন একটি গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত যাদের মধ্য থেকে পাঁচজন নোবেল প্রাইজে ভূষিত হয়েছেন।
নাভকগ বর্তমানে পাইলট পর্যায়ে করা হচ্ছে এবং আইবিএম বলছে সাধারণ মানুষের কাছে অ্যাপটি পৌঁছে দেয়ার খুব কাছাকাছি তারা।
‘আমাকে আরও নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছে’
দৃষ্টিহীনদের জন্য এক সম্মেলনে পরীক্ষামূলক-ভাবে ‘নাভকগ’ ব্যবহার করেছেন ৭০ বছর বয়স্ক ক্রিস্টিন হানসিঙ্গার এবং তার স্বামী ডগলাস হানসিঙ্গার দম্পতি। তারা দুজনেই অন্ধ।
মিসেস হানসিঙ্গার তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “অনুভূতিটা এমন ছিল যে আমি আমার নিজের অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছি”।
এটা অচেনা জায়গায় চলাফেরায় আরও বেশি স্বস্তি দেয় বলে তিনি জানান।”এটা সত্যিই আমাকে নিজস্বভাবে অবাধ ভ্রমণের স্বাধীনতা দেয়”।
হালকা ওজনের ‘সুটকেস রোবট’
ডক্টর আসাকাওয়ার পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ হল ” কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুটকেস তৈরি-যেটি কিনা একটি হালকা ওজনের ন্যাভিগেশন সংক্রান্ত রোবট”।
বিমানবন্দরের মত জটিল কমপ্লেক্সের ভেতরে ফ্লাইটের দেরি, গেট পরিবর্তন ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে এটি অন্ধ ব্যক্তিকে পরিচালনা করে।
সুটকেসটিতে একটি মোটর যুক্ত করা আছে যাতে এটি নিজে নিজেই চলতে পারে, আশেপাশের অবস্থা বোঝার জন্য ছবি শনাক্তকণ ক্যামেরাসহ আরও অনেক কিছু রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আরোহীকে সুটকেস নিজেই জানায় তাকে তোলার জন্য।
রোবটের সাথে একত্রে কাজ করলে সেটি হালকা, ছোট এবং স্বল্প ব্যয়ের হবে-জানান ডক্টর আসাকাওয়া। বর্তমানে প্রচলিত প্রযুক্তি আরও ভারী।
তিনি বলেন, “আমি সত্যিই এক একা ভ্রমণ উপভোগ করতে চাই, সেকারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুটকেস-এর দিকেই মনোযোগ দিতে চাই এমনকি তাতে যদি সময় বেশি লাগে তো লাগুক”।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার
খবরে জানা যায়, এবছরই গুগলের লুকআউট অ্যাপস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে প্রাথমিকভাবে পিক্সেলে যেখানে দৃষ্টি-শক্তিহীনদের বর্ণনা দেবে এবং গাইড করবে ।
যখন কোন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো হয় তখন প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। তবে গত কয়েক বছরে তার পরিবর্তন হচ্ছে বলে জানান সিসিএস ইন-সাইটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণা প্রধান নিক ম্যাককুয়ার ।
তবে মাইক্রোসফট এবং গুগল যারা গত বারো মাসে মাইক্রোসফট এই খাতে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে।
তিনি বলেন প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজের ক্ষেত্রে দখল করে নিচ্ছে এমন নেতিবাচক প্রচারণার মাঝে এই ধরনের সামাজিক অবদান ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও আর্টিফিশাল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নিখুঁত হওয়া এখনো অনেক দূরের ব্যাপার। এই অ্যাপ্লিকেশন কতটা সঠিক এবং তার গতি কতটা তা প্রমাণ-সাপেক্ষ।
তবে ডক্টর আসাকাওয়ার সহজ ভাষ্য: “আমি অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম তা মোকাবেলার করে গেছি। আমি আশা করি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে”।
সূত্র, বিবিসি