উপকূল অতিক্রম করার পর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরিণত হয়েছে গভীর স্থল নিম্নচাপে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ রোববার সকাল ১০টায় এক ব্রিফিংয়ে বলেন, বিপদ কমে আসায় দেশের চার সমুদ্রবন্দরকে সংকেত কমিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি চলে আসার পর শনিবার সকাল থেকে মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত এবং কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখানো হচ্ছিল।
ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে এ ঘূর্ণিঝড়।
প্রায় তিন ঘণ্টায় পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসার পর সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের কাছ দিয়ে বুলবুল পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করে।
রোববার ভোর ৫টার দিকে সুন্দরবনের কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূল অতিক্রম করে খর্ব শক্তির ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছায়। এরপর আরও শক্তি হারিয়ে গভীর স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়।
শামসুদ্দিন আহমেদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “বুলবুল এখন স্থল নিম্মচাপ হিসাবে অবস্থান করছে বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও খুলনা এলাকায়। আমরা স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছি। ১০০ কিলোমিটার বেগের ঝড় এসে একেবারে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে তেমন আশঙ্কা আর নেই। তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা লাগতে পারে।”
আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনানা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কুমিল্লা, ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
নিম্নচাপটি আরও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হতে হতে এক সময় মিলিয়ে যেতে পারে।
বিপদ সংকেত নামিয়ে সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলার পাশাপাশি দেশের নদীর বন্দরগুলোর জন্য ২ নম্বর নৌ সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সেই সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গত ২৪ ঘণ্টায় সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ৮১ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিপ্তর শুক্রবার সন্ধ্যায় বিপদ সংকেত জারি করার পর সমুদ্রবন্দরগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ।
পাশাপাশি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে শনিবার বিকাল ৪টা থেকে ১৪ ঘণ্টা বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিপদ কেটে যাওয়ায় বিমান চলাচল স্বাভাবিক করা যাবে। ফেরিও চলাচল করতে পারবে। তবে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত নামিয়ে ১ নম্বর হলে তখন লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক হবে।
এদিকে ঝড়ের দাপট কমে আসার পর দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আসতে শুরু করেছে। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের উত্তর রামপুর গ্রামে গাছ উপড়ে বসত ঘরের ওপর পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া লক্ষ্মীপুরের রামগতি, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, ভোলার লালমোহন ও চরফ্যাশনসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ার এবং কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহামম্দ মহসিন জানিয়েছেন, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা তথ্য সমন্বয় করে দুপুরের দিকে তারা ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক চিত্র দিতে পারবেন।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে শনিবার রাত পর্যন্ত যে ২১ লাখ মানুষকে উপকূলী অঞ্চলের ৫ হাজার ৫৮৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন বলে অতিরিক্ত সচিব জানিয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতি ভারতেও
বুলবুলের প্রভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনিপুর, কলকাতা এবং ওড়িশা রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়ায় বহু গাছ উপড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। অনেক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুই রাজ্যে ঝড়ে অন্তত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
উপকূলে আঘাত হানার পর প্রায় ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তীর্ণ লাকায় তাণ্ডব চালায় ‘বুলবুল’। ভারী বৃষ্টিতে নষ্ট হয় ফসলের ক্ষেত।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া বলছে, এই ঝড়ের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কাকদ্বীপ ও বকখালি এবং পূর্ব মেদিনিপুরের খেজুরি, নন্দগ্রাম, নয়াচর ও রামনগর এলাকা। উপকূলীয় এসব এলাকায় ঝড়ো বাতাসে গাছ উপড়েছে, অনেক ঘরের চাল উড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দোকানপাট। অনেক এলাকা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪