জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরীঃ আগামী ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১০ই জ্বিলহজ, রোজ মঙ্গলবার পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়েও মর্যাদা সম্পন্ন, কেননা এ দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। এদিনে সালাত ও কোরবানী একত্র করা হয়। যা ঈদুল ফিতরের সালাত ও সদকাতুল ফিতরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (সাঃ) কে কাওছার দান করেছেন, এর শুকরিয়া আদায়ে তিনি তাকে কোরবানী ও সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরবানীর দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন, আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলে করিম (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ’র নিকট দিবস সমুহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কোরবানীর দিন, তারপর পরবর্তী ৩ দিন। তাই মুসলিম উম্মাহ’র জন্য ঈদুল আযহার দিন ও পরবর্তী ৩ দিন অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও অতি মর্যাদা সম্পন্ন। ঈদুল আযহার দিনে সালাত আদায়ের পাশাপাশি পশু কোরবানী মুসলমানদের জন্য একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত এবং আনন্দময় উৎসব।
কোরবানীর বিষয়টি মানব ইতিহাসের মতো অতি প্রাচীন। হযরত আদম (আঃ) এর পুত্রদ্বয় হাবীল ও কাবীলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোরবানীর সূচনা হয়। সেসময় কোরবানীর নিয়ম ছিল অন্যরকম। ভেড়া, দুম্বা, শষ্য বা গম আল্লাহ’র দরবারে পেশ করা হতো, যার কোরবানী কবুল হতো আল্লাহ’র হুকুমে আকাশ হতে আগুন এসে তা ভষ্মিভূত করে দিত, আর যারটা কবুল হতো না তারটা পড়ে থাকতো। হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইয়াকুব (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ) এর সময়েও কোরবানীর প্রচলন ছিল। তবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম জাতির জনক ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ’র প্রেমে তার প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে এক অবিস্মরনীয় সোনালী ইতিহাস তৈরী করে গেছেন।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নযোগে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আল্লাহ’র পক্ষ থেকে আদেশ লাভ করেন। তিনি পরপর ৩ দিন প্রতিদিন ১০০টি করে মোট ৩০০টি পশু (উট) কোরবানী করেন। কিন্তু তা কবুল হলো না। বারবার আদেশ হলো তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানী করো। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন তার প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হবে। হযরত ইসমাঈল (আঃ) নিজের জানকে আল্লাহ’র রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্ধিধায় সম্মত হয়ে আত্নত্যাগের এক অবিস্মরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহ’র পরীক্ষা। তাই পিতার ধারালো ছুরি শিশুপুত্রের একটি পশমও কাটতে পারেনি। পরিবর্তে আল্লাহ’র হুকুমে দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টার প্রেমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট কোরবানী।
ত্যাগের সু-মহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরনীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতের উপর পশু কোরবানী ওয়াজিব করে দিয়েছেন। উম্মতে মুহাম্মদির কোরবানী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কোরবানীকে স্মরন করিয়ে দেয়। ইব্রাহীম (আঃ) এর গোটা জীবন ছিল কোরবানী তথা অতুলনীয় আত্নোৎসর্গ ও আত্নত্যাগের মহিমায় উজ্জল। প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করা ছিল ইব্রাহীম (আঃ) এর জীবনের অসংখ্য কোরবানীর চরম ও শ্রেষ্টতম ঘটনা। তাদের স্মরনে পশু কোরবানীর এ বিধান রোজ কেয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সালাত আদায়ের পাশাপাশি পশু কোরবানী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। বালিগ, মুকিম (মুসাফির নয় এমন ) ব্যক্তি ১০ জিলহজ্ব ফজর হতে ১২ জিলহজ্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হয় তার উপর কোরবানী ওয়াজিব। কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদ পুরো এক বছর নিজ আয়ত্বে থাকা শর্ত নয়, বরং যে অবস্থায় সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয় ঐ অবস্থায় কোরবানী করাও ওয়াজিব হয়। কোন মহিলা নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হলে তার উপরও কোরবানী ওয়াজিব। তবে মুসাফির ব্যক্তির উপর কোরবানী ওয়াজিব নয়।
কোরবানীর ফজিলত ও সওয়াব সম্পর্কে হাদিস শরীফে এসেছে, কোরবানীর ঈদের দিন আদম সন্তান যে সকল আমল করে তার মধ্যে আল্লাহ’র নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, কোরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কোরবানীর পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, নাড়িভূড়ি ও চুল-পশম নিয়ে উপস্থিত হবে। আর তার রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহ’র নিকট কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা তা আনন্দের সাথে পালন করো (ইবন মাজাহ : সুনান)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুল (সাঃ) কে কোরবানী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, এটা হলো তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নত। তারা বলেন এর বিনিময়ে আমাদের জন্য কি রয়েছে? রাসুল (সাঃ) বলেন প্রতিটি চুলের জন্য রয়েছে একটি নেকি। তারা বলল, তাহলে পশমের কি হবে? তিনি বললেন, প্রতিটি পশমের জন্যেও রয়েছে একটি করে নেকি (ইবন মাজাহ : সুনান ও আহমাদ : মুসনাদ)।
বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতি বছর পশু কোরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ’র সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করেন। এ কোরবানীর শিক্ষা কি তা আমাদের জানা থাকা দরকার। মনে রাখতে হবে কোরবানী কেবল মাত্র পশু জবেহ করা নয় । কোরবানী হলো নিজের ভিতরের পশু সত্বাকে জবেহ করা। এর মানে মনের সকল কুপ্রবৃত্তিকে খতম করা। কোরবানীর মর্যাদা ও ফজিলত সম্মন্ধে আমরা অনেক মুসলমান অনেক অজ্ঞ। আর অজ্ঞ বলেই কোন কোন লোক নামের জন্য লোক দেখানো কোরবানী করে থাকেন, আবার অনেক লোক দুর্বল, অস্বাস্থ্যবান এবং কম দামের পশু কোরবানী করে থাকেন। অথচ প্রিয় সন্তানের পরিবর্তেই পশু কোরবানী করতে হয়। তাই সবচেয়ে ভালো, স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ চতুষ্পদ পশু কোরবানী করা প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় যে, সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও অনেকে কোরবানী করেন না, অথচ সামর্থবান ব্যক্তিদের জন্য কোরবানী করা ওয়াজিব। এই ওয়াজিব কাজ যারা তরক করেন তাদের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিশাপের কথা বলা হয়েছে। যেমন এক হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থবান হওয়া সত্বেও কোরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকট আসে না।
কোরবানীর মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভ করেছেন। আমাদের প্রিয় রাসুল (সাঃ) এই কোরবানীর তরিকা শিখিয়ে দিয়েছেন। নিয়তের বিশুদ্ধতা সহ কোরবানীর সকল আহকাম মেনে, রাসুল (সাঃ) এর প্রদর্শিত তরিকায় আমরাও যদি ঈদুল আযহার কোরবানী করতে পারি তাহলে আল্লাহ’র দরবারে আমাদের কোরবানী কবুল হবে। হে আল্লাহ বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে, সকল নিয়ম ও আহকাম মেনে আমাদেরকে কোরবানী করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ সমাজকর্মী ও কলামিস্ট।