বাহরাইনে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ওপর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার খবর পাওয়া গেছে। দেশটির সরকার ফ্রি ভিসায় যাওয়া ২২ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকের ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। মাসিক মাত্র ১০ দিনার ট্যাক্স না দেয়াই এ ভিসা বাতিলের কারণ বলে জানা গেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিসা বাতিল হয়ে যাওয়ায় বিপুল বাংলাদেশী অবৈধ হয়ে পড়েছেন। ফলে এখন তাদের ওপর চলছে গ্রেফতারি অভিযান।
অভিযানটি ঘোষণা দিয়ে না হলেও এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশীদের ওপর। পুলিশি ধরপাকড় এড়াতে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার শ্রমিক দালালের প্রলোভনে পড়ে দেশটিতে গিয়ে এখন কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এর মধ্যে অনেকে আবার ভালোও আছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সে দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ভিসাসংক্রান্ত কোনো আবেদন জমা নিচ্ছে না এবং কোনো সত্যায়নও হচ্ছে না বলে সূত্রে জানা গেছে।
বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ফাস্ট সেক্রেটারির (শ্রম) সাথে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ২২ হাজার শ্রমিকের ফ্রি ভিসা বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত হতে কয়েকবার যোগাযোগ করেও কারো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে একাধিক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে ভিসা ট্রেডিংয়ের অংশই হচ্ছে ফ্রি ভিসা। তারা স্পন্সরের আওতায় চাকরি করে না। কিন্তু নিয়োগকারী কোম্পানির সাথে আগেই দালালদের অলিখিত চুক্তি থাকে, কোম্পানির নামে শ্রমিক যাবে, কিন্তু সে কোম্পানিতে তারা কাজ করবে না; অন্য যেকোনো স্থানে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। দেখা গেছে শ্রমিক সেখানে যাওয়ার পর ফ্রি ভিসায় অনেকে কাজ পায় না। উল্টো প্রতারিত হয়ে কস্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। ভুক্তভোগীরা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ওই দেশের লেবার মিনিস্ট্রির সাথে দ্রুত বৈঠক করা, যাতে কোম্পানি মালিকদের এ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা যায়। চুক্তি মোতাবেক শ্রমিক যাবে এবং সে ক্ষেত্রে তারা চাকরি নিশ্চিত করবে। এ বিষয়টিই যৌথ কমিটির সাথে বৈঠক করে তুলে ধরতে হবে। তাদের মতে, এসব অনিয়মের সাথে স্থানীয় পুরনো শ্রমিকদের সাথে ওই দেশের মালিকদের যোগসাজশই মূলত দায়ী।
গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮টায় বাহরাইনের রাজধানী মানামা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক মনির হোসেন ও কাজল মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের এই ছোট্ট দেশটিতে বেশির ভাগ বাংলাদেশী কর্মীর দিন কাটছে কষ্টের মধ্যে। এর মধ্যে গত ১২-১৫ দিন আগে বাহরাইনের লেবার মার্কেট রেগুলেটরি অথরিটি (এলএমআরএ) ফ্রি ভিসায় যাওয়া ২২ হাজার শ্রমিকের ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। এ নিয়ে গালফ নিউজসহ একাধিক পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। তারা বলেন, এমন সংবাদের পর শত শত শ্রমিক বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর পর থেকেই দূতাবাস ভিসাসংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। কী কারণে বাহরাইন সরকার হঠাৎ কর্মীদের ফ্রি ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে আট বছর ধরে দেশটিতে থাকা প্রবাসী শ্রমিক মনির হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, যারাই ফ্রি ভিসায় আসছে তাদের প্রতি মাসের জন্য সরকার নির্ধারিত ১০ দিনার অর্থাৎ দুই হাজার ৫০ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স নির্ধারণ করে দিয়েছে লেবার মার্কেট রেগুলেটরি অথরিটি। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকের নামে সরকার নির্ধারিত এ ট্যাক্স পরিশোধ না করার কারণে তাদের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্রি ভিসায় এসে শ্রমিকরা বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফল, মাছ বিক্রি করছে, যা এ দেশের আইনে নিষিদ্ধ। তারপরও হাজার হাজার শ্রমিক দালালের খপ্পরে পড়ে এখন বিপদের মধ্যে আছেন। তারা না পারছেন দেশে ফিরতে না পারছেন শান্তিতে কাজকর্ম করতে। এমন শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, ঘোষণা দিয়ে অবৈধ শ্রমিক ধরপাকড় হচ্ছে না, তবে অভিযানে যারা (অবৈধ কর্মী) আটক হচ্ছেন তাদের জেল জরিমানার পর দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দুই মাসে দেশটিতে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে গেছেন ৯ হাজার ৬৫৫ জন কর্মী। এর মধ্যে নারী শ্রমিক পাঁচজন। এর আগে ২০১৬ সালে দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন ৭২ হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ৭৯ জন মহিলাকর্মী।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ২২ হাজার ফ্রি ভিসা বাতিল প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাবেদ আহমেদ এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ টেলিফোন ধরেননি।
মানামায় মানবেতর জীবন কাটানো শ্রমিক কাদির হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, এ দেশে পুরনো শ্রমিকদের মনোনীত দেশে থাকা দালালদের খপ্পরে পড়েই মূলত চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে বাহরাইনে আসছেন অনেকে। না জেনে এই ভিসায় এসে তারা বিপদে পড়ছেন। কারণ বাংলাদেশী শ্রমিক বেশি হয়ে গেছে। সেই তুলনায় কাজ কম। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, অনেকে ঠিকমতো তিন বেলার খাবারও জোটাতে পারছে না। কিভাবে ১০ দিনার সরকারি ফি দেবেন তারা? তার দেখা মতে, যারা দুই বছরের ফ্রি ভিসায় এসেছেন, তাদের কারো তিন থেকে ছয় মাস না যেতেই লেবার মার্কেট অথরিটি ভিসা বাতিল করে দিচ্ছে। কারণ ভ্যাট ট্যাক্স কোম্পানি পরিশোধ করছে না। এখন যারা ধরা পড়ছেন তারা জেল জরিমানা দিয়েই দেশে ফিরছেন। যেহেতু ভিসার সমস্যা তাই এই মুহূর্তে দেশ থেকে কারো না আসাই উচিত বলে মনে করেন তিনি।