সৌদি আরবে পবিত্র মক্কায় ওমরাহ শেষে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন ওই পরিবারের আরও দুই সদস্য। নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর।
মক্কায় ওমরাহ পালন শেষে দাম্মামে ফেরার পথে আরবের আল-কাসিম এলাকায় গত শনিবার (৫ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় ওই তিন বাংলাদেশি মারা যান।
নিহতরা হলেন- মোবারক হোসেন (৪৮), তার ছেলে তানজিল আব্দুল্লাহ মাহি (১৫) ও মেয়ে মাহিয়া (১৩)। মাহি ওই দেশের নবম শ্রেণিতে ও মাহিয়া সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা করতো।
আহত হন মোবারক হোসেনের স্ত্রী শিখা আক্তার (৪০) ও বড় মেয়ে মিথিলা ফারজানা মীম (১৯)। উচ্চ শিক্ষার জন্য চলতি মাসের ২৩ তারিখ মীমের কানাডা যাওয়ার কথা ছিল। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলিতে ২০০৬ সাল থেকে বসবাস করে আসছেন শেখ মোহাম্মদ আলী। তিনি ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। মোহাম্মদ আলীর দ্বিতীয় সন্তান মোবারক হোসেন।
সূত্র আরও জানান, মোবারক হোসেন উন্নত জীবনের আশায় ২০ বছর আগে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। এরপর দুই ভাইকে নিয়েছেন সৌদি এবং এক ভাইকে পাঠিয়েছেন দুবাইয়ে। মোবারক হোসেন স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সৌদি আরবের দাম্মাম শহরে বসবাস করতেন। সেখানে তার গাড়ির ওয়ার্কশপ রয়েছে।
আজ রবিবার (০৬ আগস্ট) সরেজমিনে নিহত মোবারক হোসেনের ফরিদপুরে শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তান, নাতি-নাতনিকে হারিয়ে মোবারক হোসেনের বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের শুধু চোখ বেড়ে পানি পড়ছে। অসুস্থ আলেয়া বেগম কোনো কথাই বলতে পারছেন না। মোবাইলে ছেলে, নাতি নাতনিদের ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। বড় ভাইকে হারিয়ে ভাই-বোনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
মোবারক হোসেনের ছোট ভাই জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, ৬ মাস আগে বড়ভাই ও তার স্ত্রী- সন্তান দেশে এসে কিছুদিন থেকে আবার চলে যান। ভাইয়ের বড় মেয়ে মিথিলা ফারজানা মীমের ২৩ আগস্ট উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল। এ কারণে স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে ওমরাহ করতে যান তিনি। ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
জাহাঙ্গির হোসেন আরও বলেন, এক সময় নদী ভাঙনে আমাদের বসতভিটা বিলীন হয়ে যায়। ভাই সংসার টেনে ওঠাতে চলে যান সৌদি। অনেক কষ্ট করে আমাদের ভাই বোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। দুই ভাইকে সৌদি নিয়েছেন, আরেক ভাইকে দুবাই পাঠিয়েছেন। বোনদের বিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বাড়ি করে দিয়েছেন। ভাই শুধু আমাদের দিয়েই গেছেন, আমরা ভাইয়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি।
মোবারক হোসেনের ছোট বোন নাজিয়া আফরোজ রিক্তা বলেন, এক সপ্তাহ আগে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভাই বললেন, আমি ওমরাহ করতে যাচ্ছি আমার জন্য দোয়া করিস। বড় ভাই ছিল আমাদের বটগাছ। সব সময় আমাদের সব আবদার পূরণ করতেন।
মোবারক হোসেনের বাবা শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার মোবারকের জন্যই আজ আমাদের অবস্থার উন্নতি। কি করলে আমরা একটু ভালো থাকবো, সব সময় ওর মাথায় এই চিন্তাই থাকতো। বলতো আব্বা আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, যখন যা লাগবে আমাকে জানাবেন। আমার কোনো কিছুই চাওয়া লাগতো না ওর কাছে।
মোহাম্মদ আলী কথা বলছিলেন আর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। এক সময় ছেলের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার ছোট ছোট নাতি-নাতনি আমাকে কতো ভালোবাসতো। কিছুদিন আগেই ওরা এসেছিল। আমাকে কি পড়লে ভালো লাগে, কি খেতে ভালো লাগে সব সময় শুনতো। ওদেরকে ভুলবো কি করে। এই বৃদ্ধ বয়সে আমি সহ্য করতে পারছি না। বাবা বেঁচে থাকতে ছেলের মৃত্যু কীভাবে মেনে নেব। আমার সব শেষ হয়ে গেল। ও শুধু আমাদের জন্য করেই গেলো; আমরা ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
তিনি বলেন, সংবাদ পাওয়ার পর আমার ছেলের শ্যালক সৌদি চলে গেছেন। আমার ছেলে, নাতি-নাতনিদের মরদেহ দেশে আনার কথা বলেছি। ওদের এক নজর শেষ দেখা দেখতে চাই।