সিরাজী এম আর মোস্তাকঃ বাংলাদেশে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় দুই লাখ যোদ্ধা এবং একচল্লিশ বীরাঙ্গনার যে তালিকা রয়েছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর নাম নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে খেতাব দিয়েছিলেন, তাতেও তার নাম নেই। অর্থাৎ তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। তাহলে কি তিনি রাজাকার? কখনো নয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম নেই কেন?
জনাব ওসমানী ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বৃটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই ছিলেন সর্বাধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর এবং বাহিনী সমূহ তার অধীনে ছিল। এদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী জনতা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সর্বাত্মক লড়াই করেন এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিজয় ছিনে আনেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে খেতাব দিয়ে অবশিষ্ট সকল জনতা, শহীদ, বন্দী ও আত্মত্যাগী নির্বিশেষে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ ঘোষণা করেন। একজন বন্দী যোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজেও ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেন। এ আদর্শ অনুসারে জনাব ওসমানীও বঙ্গবন্ধুর ন্যায় ‘সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় দেন।
বর্তমানে সে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি চরমভাবে বিকৃত হয়েছে। প্রায় দুই লাখ যোদ্ধা ও একচল্লিশ নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। তারা এবং তাদের পরিবার-পরিজন মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদে অবৈধ প্রাধান্য পেয়েছে। যেন শুধু তারাই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। অন্য সবাই রাজাকার। খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানিও মুক্তিযোদ্ধা নয়, বরং রাজাকার। এভাবে ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনও মুক্তিযোদ্ধা নয়। যে হাজার হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাক হানাদারমুক্ত করেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা নয়। লাখ লাখ বন্দী ও শরণার্থীও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভুত। অর্থাৎ তালিকাবিহীন সবাই রাজাকার।
মূলত ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি যেমন মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি রাজাকার। কেউ পাকিস্তানি রাজাকার, কেউ ভারতীয় রাজাকার। যারা পাকিস্তানের সহায়তা পেয়েছে, তারা পাকিস্তানি রাজাকার। আর যারা ভারতের সহায়তা পেয়েছে, তারা ভারতীয রাজাকার। যুদ্ধকালে দেশে অবস্থানকারী সকল জনতাই পাকিস্তানি রাজাকার। আর ভারতে অবস্থানকারী সকল নেতৃবৃন্দ, তথায় প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এবং শরণার্থীগণ ভারতীয় রাজাকার। যেহেতু জনাব এম এ জি ওসমানী ভারতের সহযোগীতায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং বাংলাদেশে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম নেই, তাই তিনিও ভারতীয় রাজাকার।
্এ রাজাকারি চেতনা মুক্তিযুদ্ধেই শুরু হয়েছিল। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু ও পাকিস্তান সামরিক সরকারের সমঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হলে যুদ্ধের আবহ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের আত্মগোপনে বা ভারতে যাবার নির্দেশ দেন। তাজউদ্দিন আহমদসহ প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকেও আত্মগোপনের পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু তা উপেক্ষা করে জবাব দেন, ‘তোমরা পালাও কিন্তু আমি নয়। আমি পালালে, পাকবাহিনী শুধু আমাকে বা শেখ মুজিবকে খোঁজার নামে বাংলার সাধারণ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবে। তাই বাংলার মানুষের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করছি।’ এভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মী ড. কামাল হোসেনসহ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে অবরূদ্ধ হন। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারি চেতনা শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, “রাজাকার এ অভিধাটি ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে হায়দারাবাদে ভারতীয়দের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিজামের স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যবহার করেছিল।” (ফজলুল কাদের কাদরী, বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস, পৃষ্ঠা-১৩২, বাংলা অনুবাদ-দাউদ হোসেন)।
বঙ্গবন্ধুর এ আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জনাব এম এ জি ওসমানী দেশের সাড়ে সাত কোটি জনতাকে গেরিলা বাহিনীর সদস্যভুক্ত করেন। তিনি এগারটি সেক্টরসহ অসংখ্য বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সঠিক নির্দেশনা প্রদান করেন। যুদ্ধকালে পাকবাহিনী কোনো এলাকায় আক্রমণ করলে দেশে অবস্থানরত সংগ্রামী জনতা গেরিলা কৌশল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ন্যায় জীবনের মায়া ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে আসেন। পাকবাহিনীকে আশ্বস্ত করেন, তদীয় এলাকায় পাকিস্তান বিরোধী কেউ নেই। তারা দিনে পাকবাহিনীকে সহযোগীতা করেন, আর রাতে তাদেরই বিরূদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তারা অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের প্রাণরক্ষাসহ মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তারা বঙ্গবন্ধু ও জনাব এম এ জি ওসমানীর আদর্শে উজ্জীবিত এক একজন বীর সেনা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন তাদেরই অন্তর্গত। তারা যুদ্ধকালে ভারতপ্রবাসী তথা প্রশিক্ষণের নামে সেখানে অবস্থানকারীদের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর বিশেষ ক্যু’য়ের ফলে দেশীয় যোদ্ধাগণ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বঞ্চিত হয়ে ‘পাকিস্তানী রাজাকার’ সাব্যস্ত হন আর ভারতীয় রাজাকারগণ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃত হন। বঙ্গবন্ধু এবং এম এ জি ওসমানী উক্ত মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বঞ্চিতদের দলভুক্ত।
তাই, যতদিন প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু এবং এম এ জি ওসমানীসহ ত্রিশ লাখ শহীদ ও ৭১’এর প্রকৃত যোদ্ধাগণ রাজাকার বিবেচিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা ইতিহাস রচিত হবে। শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হবে। জাতি আরো বিভক্ত হবে এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। এজন্য উচিত, বঙ্গবন্ধু ও এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করা। তাদের ন্যায় ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেও মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করা। ত্রিশ লাখ শহীদ, সকল বন্দী ও শরণার্থীদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া। প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা। দেশের প্রতিটি নাগরিককে ‘৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা।
অতএব, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশবাসীর কাছে সশ্রদ্ধ জিজ্ঞাসা, প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসারে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জনাব এম এ জি ওসমানি মুক্তিযোদ্ধা নাকি রাজাকার?
এ্যাডভোকেট, ঢাকা।
mrmostak786@gmail.com.