সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থতার দায় সবার মন্তব্য করে আবারও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঢাকার মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
বৃহস্পতিবার ঢাকার গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে ট্রাফিক সচেতনতায় এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার অনেকগুলো গত বছরও দিয়েছিলেন তিনি।
গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকায় বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা; নজিরবিহীন সেই আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানী।
সড়কে পুলিশের দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা নিয়ে নেওয়ার পর পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আইন না মানার চিত্রও বেরিয়ে পড়েছিল। তখন সব দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরানো হয়েছিল।
সাত মাস বাদে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর আবারও ফুঁসে উঠেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে পুলিশ কমিশনার বলেন, “মেধাবী ছাত্র আবরারের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা রাস্তায় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারিনি।
“এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। এর দায়ভার কেউ এড়াতে পারেন না। আমরা কেউ চাই না এরকম দুর্ঘটনা হোক। সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে কাজ করলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা দেখতে হত না।”
তিনি বলেন, “সুপ্রভাত পরিবহনের (যে বাসের চাপায় আবরার মারা যান) বাসটির ঢাকায় চলাচলের অনুমতি ছিল না। ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রুট পারমিট ছিল ওই বাসটির। শুধু তাই নয়, ওই বাসটির নামে এর আগে ২৭ বার প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছিল। তাহলে সুপ্রভাত পরিবহনের এই বাসটি রাজধানীতে কীভাবে চলাচল করছিল?”
অনুষ্ঠানে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
তাদের উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে রাজপথে পুলিশকে সহযোগিতা করেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক। সেজন্য আমরা আপনাদের শ্রদ্ধা করি।
“তবে শুধু আলোচনা করে সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধান আসবে আলোচনা বাস্তবায়নের উপর।”
সড়কে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর পদ্ধতিকে দায়ী করেন ডিএমপি কমিশনার, যা গত বছরের আন্দোলনের মুখে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, “চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর ফলে রাস্তায় যানজটসহ সৃষ্টি হচ্ছে দুর্ঘটনা।
“ড্রাইভারকে কোনো অবস্থায় চুক্তিভিত্তিক গাড়ি দেওয়া যাবে না। আপনারা (মালিক) চুক্তিভিত্তিক গাড়ি দেওয়া বন্ধ করুন। প্রত্যেক বাস স্টপেজে টিকিট কাউন্টার বসিয়ে টিকিট দিয়ে যাত্রী উঠান। পুলিশ আপনাদের পাশে থাকবে।”
প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালালে, যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করালে, রাস্তায় গাড়ি আড়াআড়ি রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ট্রাফিক বিভাগকে নির্দেশ দেন আছাদুজ্জামান মিয়া।
তিনি বলেন, রুট পারমিট অনুযায়ী গাড়ি চালাতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে তাকে গ্রেপ্তার করে ফৌজদারি মামলা দেওয়া হবে। এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজ পর্যন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে।
পথচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হলে ওই পথচারীকে জরিমানাসহ আটক করা হবে।”
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “শ্রমিক ও মালিকবিরোধী কোনো কাজ আমরা করবো না। কিন্তু কথা দিতে হবে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, কেউ অন্যায় করলে পুলিশ ব্যবস্থা নিলে তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোকে সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, কাউন্টারে টিকিট দেওয়ার সিস্টেম চালু হলে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ হবে। এতে কমবে সড়কের দুর্ঘটনার চিত্র।
আগামী মাস থেকে কাউন্টারের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির ঘোষণা দেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে চালকদের প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়ে এনায়েত উল্লাহ বলেন, রাজউক ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতিকে পূর্বাচলে জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জায়গাটি পেলে সমিতি নিজেদের টাকায় দক্ষ চালক তৈরি করবে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা হলে আমরা সবাই একতরফা ড্রাইভারকে দোষী করি। সড়কে চলাচলে আমাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে।
“আমাদের শিক্ষা জীবনে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। সেজন্য ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।”
অনুষ্ঠানে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমদও ছিলেন।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪.কম