সংগঠক মানে সংগঠনের নেতা। আর নেতা মানে অনেক মানুষের সমর্থন পাওয়া। স্থান, কাল, পাত্রভেদে যেকোনো মানুষের মন জয় করা ভীষণ কঠিন কাজ। নেতা মানে সাধারণ মানুষ নন, মানুষদের প্রিয়পাত্র। দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাত্র। একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব যখন অগণিত মানুষকে মুগ্ধ করে, সেই মানুষটি অন্যদের কাছে অভিভাবক বা আদর্শ হয়ে ওঠেন, সেই মানুষটি তখনই স্থান পান সবার মনে। কর্মগুণে একজন সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠেন একজন মহান নেতা বা একজন পথপ্রদর্শক।
একজন নেতা সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ তখনই হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর ব্যক্তিত্বে যুক্ত হয় অনেকগুলো গুণ। যেমন : একজন নেতার মধ্যে থাকতে হবে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মনোবল ও চিন্তাশক্তি থাকাটা ভীষণ জরুরি। একজন নেতাকে যেকোনো বৈরী পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে জানতে হবে। পুরো সংগঠন বা গোষ্ঠী বা জাতি অভিভাবক মানে একজন নেতাকে, নেতৃত্বের বলিষ্ঠ গুণে একজন সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে অসাধারণ।
হতে হবে সত্যবাদী ও ধৈর্যশীল
সমাজ বা জাতি কী ভাববে, এই চিন্তা মুছে ফেলে সত্যবাদী হতে হবে। মিথ্যার জয় ক্ষণস্থায়ী। সত্যের জয় চিরস্থায়ী। এই তীব্র সত্যকে বুকে ধারণ করেন একজন মহান নেতা। সত্য বলার সঙ্গে থাকতে হবে বিপদে ধৈর্য ধারণের দৃঢ় মানসিক শক্তি। একজন বড়মাপের নেতা যেকোনো বিপদে মনোবল হারান না। তিনি পুরো জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে থাকেন। আনন্দ-বেদনা সবকিছুর মধ্যে তিনি থাকেন তাঁর দায়িত্বে অটল।
থাকতে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিক সাহস
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন সিদ্ধান্তটি জনগণ বা অনুসারীদের জন্য নিরাপদ, সেই চিন্তাটিও মাথায় রাখাটা যথেষ্ট জরুরি।
চাই বন্ধুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভঙ্গি
জীবনে কষ্ট থাকবেই। ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে সামনে চলতে হবে। জয়লাভের জন্য চাই জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা, সংগঠনকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নেতাকে হতে হবে সৃজনশীল ও সুশিক্ষিত। মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার অতুলনীয় ক্ষমতা থাকে একজন নেতার মস্তিষ্কে।
দরকার অফুরন্ত সাহস
নেতা হওয়ার জন্য প্রয়োজন বৈরী পরিস্থিতিতে অফুরন্ত সাহস। মানসিক শক্তি থাকতে হবে খুব বেশি একজন শ্রেষ্ঠ সংগঠক বা নেতার। একজন মহৎ নেতার উদ্দেশ্য থাকে দলের একজনকে খুশি করা নয়, পুরো জাতির মঙ্গলসাধনই হলো একজন মহান নেতার উদ্দেশ্য। একজন দক্ষ নেতাকে হতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি হন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। জনগণের ভালো-মন্দ তিনি সবার আগে বোঝেন বা গুরুত্ব দেন।
হতে হবে স্বপ্নদ্রষ্টা
বিপদ যেকোনো মানুষের জীবন বা সংগঠনের জন্য অপরিহার্য। তাই বলে মন ভেঙে ফেললে চলবে না। একজন নেতা হচ্ছেন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি দুঃখের মধ্যেও মনোবল হারান না। পুরো সংগঠনকে উৎসাহিত করেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
প্রয়োজন চারিত্রিক গভীরতা
চারিত্রিক গভীরতা ও দৃঢ়তা থাকাটা ভীষণ জরুরি। একজন নেতার এমন কিছু করা উচিত নয়, যা অন্যের জন্য হবে হাস্যকর। কারণ, দলের প্রধান নেতাকে সবাই অনুকরণ করে। তাই দলনেতাকে হওয়া উচিত দলের আদর্শ। যাকে অনুসরণ করে একজন মানুষ হবে অনুপ্রাণিত। যেমন: নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি নেতা হিসেবে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক সম্মানিত।
ভেদাভেদপূর্ণ অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক
একজন বড়মাপের নেতার মনে অহমিকা থাকাটা উচিত নয়। তাঁকে স্মরণ রাখতে হবে যে ভেদাভেদপূর্ণজ্ঞান দলের মধ্যে ফাটল ধরায়। অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ভালো হওয়ার জন্য দলের বা সংগঠনের সবার মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। একজন নেতা তাঁর সংগঠনকে শ্রেষ্ঠ বানানোর জন্য সংগঠনের সবার মতামতের সমষ্টিকে প্রাধান্য দেন। শুধু নিজের মতামতকে শ্রেষ্ঠ বলে সবার ওপরে চাপিয়ে দেন না।
সংগঠন মানেই একেকজনের মতামত একেক রকম হবে। কারও সঙ্গে কারওটা নাও মিলতে পারে। যেটা সংগঠনের জন্য ভালো, সেটাই গ্রহণ করতে হবে।
পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা আবশ্যক
নিজের দেহের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানে নিজেকে শ্রদ্ধা করা। একজন মানুষ সুস্থ না হলে কোনো কাজই তার ভালো লাগবে না। প্রকৃত নেতারা অসৎ সঙ্গ, নেশা, মাদক থেকে থাকেন হাজার মাইল দূরে। কারণ, একটি সংগঠনকে চালানোর জন্য নিজেক হতে হবে সুস্থ-সবল। পৃথিবীর বিখ্যাত নেতাদের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাঁরা ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট সবল।
সমাজের অসংগতিগুলো তাঁদের দুর্বল করতে পারেনি বলেই তাঁরা সাধারণ মানুষ থেকেও জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। নিজের কর্মগুণে স্থায়ী হয়েছেন ইতিহাসের স্বর্ণালি পৃষ্ঠায়।
চাই আত্মবিশ্বাস
একজন নেতাকে হতে হবে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাঁকে হতে হবে তাঁর কাজের প্রতি সৎ। সেই সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন তা যেন পুরো সংগঠনের জন্য হয় মঙ্গলজনক। সেটা তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস থাকলে মানুষ বিপদের দিনেও মনোবল হারান না। অন্য মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে সমর্থ হন।
একজন সফল নেতার কাজের ব্যাখ্যা তাঁর কাছে থাকে। তাই তাঁর অনুসারীরাও হয়ে ওঠে তাঁর মতো পরিশ্রমী। সবার মধ্যে ভালো সম্পর্ক আর আত্মবিশ্বাস থাকলে বিপদের দিনেও কর্মীরা হয়ে উঠবে কর্মতৎপর। সংগঠন এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।
থাকতে হবে জবাবদিহির পর্ব
একজন নেতাকে সব সময় তার অনুসারীদের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। মিটিংয়ের মাধ্যমে সংগঠনের ভালো-মন্দগুলোকে সবার সঙ্গে পর্যালোচনা করতে হবে। পাছে লোকে কিছু বলে, এই চিন্তা বাদ দিয়ে কীভাবে কর্মী বা অনুসারীদের আরও উন্নত করা যায়, এই চিন্তাই মুখ্য হওয়া উচিত একজন নেতার।
নেতা নিজেও তাঁর কৃতকর্মের জবাবদিহি করলে সবার মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় কাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এতে মনোমালিন্যের অবসান হবে। বড়-ছোট ভুল- ত্রুটিগুলো সব দূর হয়ে থাকে। তাই নিয়মিত বসে কাজের বা পরস্পরের প্রতি দায়িত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণটা ভীষণ জরুরি।
সঠিকভাবে কাজ বিতরণ
কাজের চাপে নেতাকে উদাসীন হলে চলবে না। খেয়াল রাখতে হবে, শুধু একজনকে দিয়েই যেন বারবার কঠিন কাজটা করানো না হয়। দায়িত্ব সবার মধ্যেই যেন সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়।
আবার, এটাও খেয়াল রাখতে হবে, সংগঠনে সবার কাজের ক্ষমতা সমান নয়। পরিবেশ, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে কাজের সুষ্ঠু বণ্টন হওয়াটা ভীষণ জরুরি।
হাস্যরসবোধ
শুধু কাজের বোঝা নিলেই চলবে না। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য সংগঠনের মধ্যে আনন্দ আড্ডা বা অনুষ্ঠান, বিনোদনের আয়োজনটাও থাকা দরকার। তা না হলে জীবন হয়ে উঠবে শুধুই কাজের বোঝা। গুরুগম্ভীরতায় মানুষ হারিয়ে ফেলবে কাজের স্পৃহা। মনে রাখবেন, আনন্দ আয়োজনটা কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়, কাজে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার জন্য।
স্বার্থহীনতা
একজন নেতাকে শুধু নিজের স্বার্থচিন্তা করলে চলবে না। একজন মহান নেতা থাকেন স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় একটি সংগঠন, যে সংগঠনে রয়েছে অনেক অনুসারী, অনেক কর্মী।
তাই শুধু নিজের স্বার্থ বা ব্যক্তিগত জীবনের কথা চিন্তা করলে চলবে না। একজন নেতার কাজকর্ম, উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন হতে হবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে তা হতে হবে পুরো সংগঠন বা জাতির জন্য।
ভালো কাজের স্বীকৃতি
কর্মীদের সমালোচনা করতে হবে তাদের আঘাত না দিয়ে। যেন সংগঠনের কারও মনে ক্ষোভ না জন্মে। দীর্ঘদিনের দুঃখ-ক্ষোভ থেকেই তৈরি হয় বড় বড় অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাই সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো রাখাটা ভীষণ দরকারি।
কোনো কর্মীর ভালো কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। এতে ভালো কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়বে। একজন সফল নেতার বৈশিষ্ট্য হলো সফল কর্মী ও সফল সংগঠন তৈরি করা।
একজন সফল সংগঠক বা নেতা এক দিনে তৈরি হয় না। দীর্ঘ বছরের শ্রম আর সাধনাতে সাধারণ একজন মানুষ বড় একজন নেতা হয়ে ওঠেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দৃঢ় হবেন মস্তিষ্কের অধিকারী যে মানুষটির রয়েছে ব্যবস্থাপনায় তীক্ষ্ণ জ্ঞান, তিনিই হবেন সফল নেতা, শ্রেষ্ঠ সংগঠক।
ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি.ইউ), পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (পাবলিক হেল্থ),
পিজিটি (গাইনী এন্ড অবস্-স্কয়ার হাসপাতাল),
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনী এন্ড অবস্),
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ,
ডায়াবেটোলোজি, বারডেম হসপিটাল (অনগোয়িং)
উপস্থাপিকাঃ ‘প্রবাসীর ডাক্তার’ বাংলাটিভিতে প্রচারিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান
সম্পাদকঃ (কুয়েত বাংলা নিউজ ডটকম) www.kuwaitbanglanews.com
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকঃ অগ্রদৃষ্টি নিউজ পোর্টাল