দেশকে স্বাধীন করতে রাঙ্গুনিয়ার হাজার হাজার বীর সেনানী বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে ৭১’রে মুক্তিযোদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এ যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যেমন বিজয়ের বেশে ফিরে এসেছিল ঠিক তেমনি অনেকে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। সাথে অনেক নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের পাক সেনারা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এক সঙ্গে মাটি চাপা দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও রাঙ্গুনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে এখনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরেও পোমরার ঐতিহাসিক গণ কবরটি এখন কেবলই গোচারণ ভূমি। এত বছরেও জীবন্ত কবরস্থ হওয়া ১৩ শহীদের আত্মত্যাগের কোন মূল্যই যেন নাই। সরকারী, বেসরকারী কোন সংস্থা এই গণকবরটির খোঁজ খবর পর্যন্ত নিচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো এই গণকবরের কোন খোজ খবর নেয়নি। তবে এখনো আশাবাদি মুক্তিযোদ্ধারা।
চট্টগ্রামে বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির নেতারা জানান, এলাকাভিত্তিক বধ্যভূমি, সম্মুখযুদ্ধের স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকা তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও ওই সব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বা সংরক্ষণের ব্যাপারে অগ্রগতি কম। ফলে একাত্তরের স্মৃতিচিহ্নগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খাইরুল বশর মুন্সি বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে যাচ্ছি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক কমিটি করার জন্য। আশারাখি অতিস্বত্ত্বর এর ফল পাবো।
জানা যায়, চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উপরেই গোচরা চৌমুহনী। পোমরা ইউনিয়নের গোচরা চৌমুহনী থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে সড়কের দক্ষিণ দিকে পোমরার বনবিটের পাশেই এই ঐতিহাসিক গণকবরটি পড়ে আছে চরম অবহেলা আর অমর্যাদায়। গণকবরটি এখন ঘাস, লতাপাতা, গাছ গাছালিতে কেবলই বন্য পরিবেশ। দিনটি ছিল ১৯৭১ সনের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলা ভাদ্র মাসের ২৬ তারিখ রবিবার। পাকবাহিনীর ৫০/৬০ জনের দলটি পোমরা শান্তিহাটের উত্তর দিকে মধুরাম তালুকদার পাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ এই হিন্দু পল্লীটির উপর বর্বরোচিত হামলা চালায় হানাদার বাহিনী। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কেউ হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। এক পর্যায়ে হানাদাররা ৭ দিন বয়সী এক কন্যা শিশু যার নাম রাখা হয়েছিল‘‘যুদ্ধবতী’’ তাকে দোলনা থেকে মাটিতে ফেলে রেখে দোলনার রশি খুলে সে রশি দিয়ে একে একে ১৮ জন পুরুষকে বেঁধে ফেলে। এরপর গরু পেটা পিটিয়ে টেনে হেঁচড়ে পোমরা বন বিটের সামনে হানাদাররা তাদের আস্তানায় নিয়ে যায় সকলকে। এখানে আনার সময় সকলকে চোখ বেঁধে দেয়া হয়। ধৃতদের নির্মম পরিণতির কথা ভেবে শত শত নারী পুরুষ পাকবাহিনীর কাছে ছুটে যায়। মহিলারা পাক বাহিনীর পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করেও তাদের মন গলাতে পারেনি। তবে ১৮ জনের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে ৫ জনকে আধমারা করে ছেড়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী। যে ৫ জন তখন ছাড়া পেয়েছিল তারা হচ্ছেন- অম্বিনী দাশ, হরে কৃষ্ণদাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ এবং হরিকিষ্ট দাশ। তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। বাকি ১৩ জনকে দিয়ে নিজেদের কবর নিজেদের খুঁড়তে বাধ্য করে হানাদার বাহিনী। পোমরা বন বিটের পাশেই উল্লাস করতে করতে হানাদাররা এই ১৩ জনকেই জীবন্ত কবর দিয়ে দেয়।
যাদের জীবন্ত কবরস্থ করা হয় তারা হচ্ছেন: মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, রমনী দাশ,হরিপদ দাশ, জগৎ চন্দ্র দাশ, বাবুল দাশ,বাবুল দাশ (২) বীরাজ দে, বোচা দে, ফকির চাঁদ দাশ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ ও শচীন দাশ। এরা সবাই তখন যুবক। কেন এই নির্মমতা, কেন মানুষ রূপী পাকবাহিনী এখন জানোয়ারে পরিণত হল তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন গ্রামের বাসিন্দা এবং তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শী পোমরা ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব জহির আহমদ চৌধুরী। তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে রাঙ্গুনিয়ার পোমরা বেতাগীতে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে সফল অপারেশনের মাধ্যমে পাকবাহিনীদের পরাস্ত করে চলছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন নুরুল আলম, (অব, আই,জি,অব পুুলিশ) সফল অপারেশনের মাধ্যামের রাঙ্গুনিয়াকে প্রায় হানাদার মুক্ত করে ছিলেন। হানাদার কর্তৃক পোমরা গণকবর রচিত হওয়ার দুইদিন আগে পোমরা শান্তিরহাটের আধ ক্রোস উত্তরে ৩৩ হাজার ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে সমগ্র রাঙ্গুনিয়াকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছিল দামাল মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনী তখন ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যায়। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে তারা। হিংস্র হায়নার দলটি প্রতিশোধ নেয় জীবন্ত গণকবরটি রচনা করে। এর কিছুদিন পরেই পোমরা হানাদার মুক্ত হয়। পরে গণকবরটি খুঁড়ে লাশ আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন অনেকেই কিন্তু পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ তখন আনা যায়নি।
এখনো গণকবর খুঁড়লে অনেক হাড়গোড় পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। শহীদ মন্টু আইচের ছেলে খোকন আইচ ও বিধবা স্ত্রী অনিমা আইচ বললেন, আমরা করুনা বা সাহায্য কিছুই চাই না। ১৩ শহীদের আত্মত্যাগের মূল্যায়ন যে দিন হবে, অন্ততঃ গণকবরটি সংরক্ষণ করে শহীদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হলে সেটি হবে আমাদের পরম পাওয়া। পোমরার সাবেক চেয়ারম্যান জহির আহমদ চৌধুরী বললেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটি সংরক্ষণের ব্যাপারে বার বার কথা দিয়েও কথা রাখেনি।
সচেতন মহলের প্রশ্ন, তবে কি রাঙ্গুনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচিহ্ন কি মুছে যাবে? তাদের দাবি সরকার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উদ্যোগ নিয়ে এই ঐতিহাসিক গণকবরটিকে সংরক্ষণ করে দর্শনীয় স্থানে পরিণত করতে পারে। এ কাজটি করা গেলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হবে নতুন প্রজন্মের।