ইসলামের বিশ্বজনীন ইবাদত পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে মক্কা মুয়াজ্জমায়। মদিনা মুনাওয়ারায় বিশ্ববাসীর হেদায়েতের জন্য আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারকে হৃদয়ের সবটুকুু ভালোবাসা উৎসর্গ করার সৌভাগ্যে আপ্লুত হাজী সাহেবান। মক্কায় পবিত্র ভূমিতে কাবাঘরকে কেন্দ্র করে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.) এর সময় থেকে। তিনটি প্রধান আসমানি ধর্মÑ ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ইবরাহিম (আ.) এর মাধ্যমে হজের নতুন আনুষ্ঠানিকতা হয় কাবাঘর নির্মাণ এবং সেই ঘর জিয়ারতে মানবজাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানোর মাধ্যমে। ইবরাহিম (আ.) এর সত্যিকার অনুসারী বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে হজ তার সবটুকু ঐতিহ্যকে ধারণ করে নেয়।
নবুয়ত লাভের পর মক্কায় ১৩ বছর জীবন শেষে তিনি যখন মোশরেকদের অত্যাচারে মদিনায় দেশত্যাগী হন এবং ১০ বছর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করেন, তখনই ইসলামের পঞ্চম ও চূড়ান্ত বিধানরূপে হজ ফরজ হয়। ইতিহাস বলে, হিজরতের আগে মক্কায় থাকতে নবী করিম (সা.) যেসব হজ করেছিলেন, তা ছিল পূর্ব থেকে চলে আসা কোরাইশদের রীতি অনুসারে। হিজরতের পর ষষ্ঠ হিজরিতে তিনি ওমরার নিয়তে (হজের নিয়তে নয়) মক্কা রওনা হয়েছিলেন এবং কোরাইশ কর্তৃক হুদাইবিয়া নামক স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। সপ্তম হিজরিতে তিনি সে ওমরা কাজা করেছিলেন। অষ্টম হিজরির রমজান মাসে তিনি মক্কা জয় করেন এবং হজরত আত্তাব বিন আসিদকে মক্কার গভর্নর নিযুক্ত করেন। পরে হজের মাস এলে তাকেই হজের আমির নিয়োগ করেন। নবম হিজরিতে তিনি আবু বকর সিদ্দিককে আমিরুল হজ করে পাঠান। দশম হিজরিতে তিনি নিজেই হজ করেন। এটিই তাঁর একমাত্র ফরজ হজ ও বিদায় হজ।
একজন বিশ্বাসী মানুষ যখন হজ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা ও মদিনার জমিনে উপনীত হন, তখন মানব ইতিহাসের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। মহাপুরুষদের আচরিত বিশ্বজনীন একটি সংস্কৃতির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ পান আর লাব্বাইকা, আমি হাজির বলে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যের স্নিগ্ধতায় বিমোহিত হন। দুই টুকরো কাপড়ে দীনহীন বেশে সব বর্ণ ভাষা ও অঞ্চলের ভেদাভেদ ভুলে হাজীরা যে চেতনায় উদ্বেলিত হন এবং বিশ্ববাসীর জন্য যে বার্তা বয়ে আনার সুযোগ পান, তা বিদায় হজে মহানবীর ভাষণে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
মহানবী (সা.) আরাফাত ময়দানে সোয়া লাখ জনম-লীকে সম্বোধন করে প্রথম যে আবেদনটি রাখেন, তা আজকের সন্ত্রাস-বিক্ষুব্ধ সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখাতে পারে। তিনি বলেন, আজকের হজের দিন, হজের মাস ও মক্কার জমিন যেরূপ সম্মানিত তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য সব সময়ের জন্য সেরূপ সম্মানিত। এর লঙ্ঘন বা হানি করা সম্পূর্ণ হারাম। মুসলিম জাতিসত্তার অংশ হয়েও আজকের বাংলাদেশে আমরা পরস্পরের রক্ত ঝরাতে যেভাবে মেতে আছি, তাতে নবীজির সেই আহ্বানের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছি কিনা, ভেবে দেখার সময় এখনই।
নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষায় নবীজি ঘোষণা করেন, স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপরও স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তোমাদের অন্দরমহলে যেন অপর কাউকে যেতে না দেয়, যা তোমরা অপছন্দ করে থাক। তারা যদি এমন কিছু করে তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। তাদের (বাসস্থানসহ) অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। মনে রাখবে, তোমরা আল্লাহর জামানতে তাদের নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়েছ। বিদায় হজের ভাষণে নবীজির এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি মহিলারা শালীনতা বজায় রেখে সমাজে বিচরণ করে আর পুরুষরা স্ত্রীদের অধিকার ও সম্মান দেয়, তাহলে প্রেমপ্রীতির বেহেশতি জীবন এ পৃথিবীতেই রচিত হওয়া সম্ভব।
মহানবী (সা.) জাহেলি যুগের শোষণের হাতিয়ার সুদ প্রথার মূলোৎপাটন করে প্রথমে আপন চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের সুদের দাবি প্রত্যাহার করে এর বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপন করেন। ছোট্ট দেশে বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বিদেশে চাল রফতানি করছি। আর্থিক নিয়ম ও দুর্নীতিতে যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছি, বিশ্বে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করলে নিশ্চয়ই আমরা প্রথম স্থান লাভ করব। বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্রে তো এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের সামগ্রিক অবস্থা বলছে, আমরা বিশ্বনবীর বিদায় হজের ভাষণ থেকে কিছুই শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করিনি। ফলে মানুষের ইজ্জত, সম্পদ ও রক্তই এখানে সবচেয়ে সস্তা।
মহানবী (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, আমি তোমাদের মাঝে দুইটি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এ দুইটি আঁকড়ে ধরবে, তত দিন পথহারা হবে না। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। দ্বিতীয় আমার সুন্নত। বিশ্বে অনেক মহাপুরুষ এসেছিলেন, তাদের অনেকের কাছে আসমানি গ্রন্থও এসেছিল। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর কিতাব কোরআন মজিদ ছাড়া কোনো ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত নেই। সেসব মহাপুরুষের জীবনচিত্র বা আচরিত ধর্মীয় রীতিনীতির বর্ণনাও এমন পর্যায়ে নেই, যা হুবহু অনুসরণ করে যে কোনো মানুষ সুন্দর পথ চলার নির্দেশনা পেতে পারে। অথচ মহানবী (সা.) এর পুরো জীবনচিত্র অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পরম্পরায় হাদিস শাস্ত্রসূত্রে আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। এক্ষেত্রে যুগে যুগে আলেম সমাজের অবদান অস্বীকার করলে আমরা অকৃতজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হবো। এরপরও এ দুইটি মূল্যবান সম্পদের আদলে সমাজ গড়তে আমাদের সংকীর্ণতার অন্ত নেই।
আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমত পর্বতে দাঁড়িয়ে প্রদত্ত মহানবীর ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষে মানুষে সাম্য। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, হে মানব সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সবার পিতা আদম (আ.)। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, অনুরূপ সাদা চামড়ার ওপর কালো চামড়ার আর কালো চামড়ার ওপর সাদা চামড়ার কোনো মর্যাদা নেই। তোমাদের মধ্যে সে লোকই অধিক সম্মানিত, যে অধিক খোদাভীরু। আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় সিক্ত সংযমী জীবনের নামই তো তাকওয়া। চিন্তা করলে বুঝতে পারব, মহানবীর এ শিক্ষার বদৌলতে মুসলিম সমাজে আজ কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। জাতপাতের কুসংস্কারে জর্জরিত ভারতবর্ষের বর্তমান সমাজেও নবীজির এ শিক্ষার সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা করলে কেউ ইসলামের প্রতি আগ্রহী না হয়ে পারে না। আমরা কথায় কথায় সোনার মানুষ, নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষের কথা বলি। অথচ তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় ও ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া মনুষ্যত্বের গুণাবলিতে সমৃদ্ধ মানুষ পাওয়া যে সহজ নয়, তা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে মহানবী (সা.) সব মানুষ এক আদি পিতা আদমের সন্তান বলে যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের হৃদয়গ্রাহী আবেদন রেখেছেন, তার তাৎপর্য আমাদের নতুন করে বিশ্ব সভ্যতায় তুলে ধরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মোমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। তারা সবাই মিলে এক অখ- মুসলিম ভ্রাতৃসমাজ। এক ভাইয়ের ধনসম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করবে না। হে মানুষেরা! শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাকবে ও তার অনুসারী হবে না। তোমরা আল্লাহর বন্দেগি করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের রোজা পালন করবে, জাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবেÑ যতক্ষণ তারা আল্লাহ ও রাসুলের পথে থাকে, তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে। সাবধান! তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। তোমরা যা খাবে, তাদের তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরও সেভাবে পরতে দেবে।
সত্যিই নানা মতবাদে বিক্ষত বর্তমান মুসলিম সমাজ যদি বিশ্ব সমাজে মহানবী (সা.) এর বিদায় হজের ভাষণের আবেদন তুলে ধরার কর্মসূচি নিয়ে জাগ্রত হয়, তাহলে আবার বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।