বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ভারতে যে বিপুল পরিমাণ জাল নোট ঢুকছে – তা ঠেকানোর জন্য একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স গড়তে দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। ঢাকায় আজ থেকে শুরু হওয়া চারদিনের এই বৈঠকেই স্থির হবে, জাল ভারতীয় নোটের পাচার রুখতে এই টাস্ক ফোর্স কীভাবে কাজ করবে।
ভারত মনে করে এই জাল নোট তাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট এক বিপদ এবং ভারতকে অস্থিতিশীল করে তুলতেই নেপাল বা বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এই সব নোট পাচার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, এই জাল নোটের উৎস বাইরের কোনও দেশ – তাদের শুধু পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি বা এনআইএ-র কর্মকর্তারা সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ভারতের অর্থনীতির জন্য এ মুহুর্তে সবচেয়ে বড় বিপদ হল জাল নোট – বাংলাদেশ বা নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে যা হু হু করে ঢুকছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মালদা সীমান্ত দিয়েই গত এক বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার জাল নোট পাচার হয়েছে বলে তাদের হিসেব।
ভারতের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার এই চেষ্টা রুখতেই গত জুন মাসে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় তিনি ও শেখ হাসিনা একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স গড়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন, যার পরিণতিতে ঢাকায় এই বৈঠক শুরু হয়েছে।
ভারতের সাবেক আয়কর কমিশনার বিশ্ববন্ধু গুপ্তর কথায়, ‘জাল নোট নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, যে হাজার টাকার নোটগুলো আসছে তার মান সাঙ্ঘাতিক ভাল, আসলের সঙ্গে আলাদা করাটাই মুশকিল। সেই কারণেই এমনটা সন্দেহ করা হচ্ছে যে এগুলো কোনও রাষ্ট্রীয় মদতে, রাষ্ট্রীয় টাঁকশালেই তৈরি করা হচ্ছে।’
ভারতীয় কর্মকর্তাদের বদ্ধমূল ধারণা, প্রতিবেশী পাকিস্তানে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মদতেই এই তাড়া তাড়া জাল ভারতীয় নোট প্রস্তুত করা হচ্ছে – তারপর হয় দুবাই বা ব্যঙ্কক হয়ে, কিংবা বাংলাদেশ বা নেপালের সঙ্গে ভারতের শিথিল সীমান্তপথে এই নোটগুলো ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই কাজে ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে বহু ঝানু স্মাগলার বা সীমান্তের গরিব মানুষদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। এ বছরের গোড়ায় ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন পাকিস্তানি দূতাবাসের এক কর্মী, ধরা পড়ার সময় তার কাছেও মিলেছিল প্রচুর জাল ভারতীয় নোটের বান্ডিল।
বিজেপি নেতা ও অর্থনীতিবিদ সুব্রহ্ম্যণ্যম স্বামী বলছেন, এই জাল নোটের কারবারে পাকিস্তানের সুবিধে করে দিয়েছে ভারতেরই বিগত ইউপিএ সরকার।
তাঁর কথায়, ‘সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের আমলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, নোট ছাপানোর কাগজ কেনা হবে ব্রিটেনের সেই কোম্পানি থেকেই – যারা পাকিস্তানকেও নোট ছাপানোর কাগজ সরবরাহ করে। যথারীতি এই নির্বুদ্ধিতার ফায়দা তুলেছে পাকিস্তানের আইএসআই, তাদের বানানো জাল নোট এখন একেবারে আসলের মতোই লাগছে।’
গত এক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যে সব জাল নোটের কনসাইনমেন্ট ধরা পড়েছে, তার মান সত্যিই চমকে দিয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও।
জাল নোট পাচারের এই রুটগুলো বন্ধ করার জন্য বিএসএফ বারবার চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও – যদিও বিজিবি-র প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গত সপ্তাহেই দিল্লিতে এসে বলে গেছেন জাল নোটের উৎস কোথায় সে সম্পর্কে তারা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘নোটগুলো যে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না, বাইরে থেকে আসছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথা থেকে আসছে সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। কিন্তু যারাই জাল নোটগুলো বানাক, তারা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে – কারণ ইদানীং আমরা খুব ঘন ঘনই বিপুল পরিমাণে জাল ভারতীয় নোট ইন্টারসেপ্ট করছি।’
সীমান্তের এই তৎপরতাকে আরও জোরদার করতে ও দুদেশের সহযোগিতাকে একটা শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতেই কাজ করবে ভারত-বাংলাদেশের ১২ সদস্যের যৌথ টাস্ক ফোর্স।
ভারতের এনআইএ ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর নোডাল এজেন্সি হিসেবে কাজ করবে, থাকবেন অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। ভারতের দিক থেকে থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সরকারের প্রতিনিধিরাও – যে দুই রাজ্যের সীমান্ত জাল নোট পাচারের রুট হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয়।