ডাক্তার ফারহানা মোবিনঃ সে অনেক দিন আগের কথা। অমুক দেশে তমুক নামক এক রাজা ছিলেন। তিনি সারাক্ষণ নৃত্য-গীত, আর সোনালী তরলে নিমজ্জিত থাকতেন। বই ছিলো তার চোখের বিষ। তার মতে, বই পড়ে খামোখা সময় নষ্ট করার চেয়ে অশ্বচালনা অথবা তরবারির লড়াই শেখাটা হাজার গুণ শ্রেয়। একদিন সন্ধ্যায় পানাসক্ত অবস্থায় উর্বশী নৃত্য দেখে সময় কাটানোর পরে সভায় ফিরে সভাসদদের জরুরী তলব করে এক কঠিন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন সবাই কে।
আজ থেকে রাজ্যে বই পড়া বন্ধ। কাউকে বই পড়া অবস্থায় ধরতে পারলে তার গলা কাটা হবে। বই পড়ে কীভাবে সময় এবং অর্থ নষ্ট হচ্ছে তার একটা বিবরণও দিয়ে ফেললেন। তোষামুদে সভাসদরা শুনে বাহবা বাহবা করতে লাগলো। কিন্তু বুদ্ধিমান উজির সাহেব বুঝতে পারলেন এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে। তবে এখনই এমন কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অপেক্ষা করতে লাগলেন মোক্ষম সময়ের। পরদিন সকাল বেলা রাজার প্রাতঃভ্রমণের সময়টাই হতে পারে যথার্থ।
এবং তার পরিকল্পনা ঠিক ভাবেই কাজে লাগলো। সক্কাল সক্কাল পেয়ে গেলেন রাজা মশাইকে।
-সুপ্রভাত মহামান্য!
-সুপ্রভাত উজির! আছো কেমন তুমি?
-জ্বী, আমি খুব ভালো আছি। আপনার পোষা টিয়া পাখি টা ভালো আছে? জেনে খুশি হবেন ,সাড়ে তিন বছর আগে যে প্রজাটির খাজনা মওকুফ করেছিলেন সে এখন নিজের জমি পেয়েছে। পাঁচ বছর আগে ঠিক এই তারিখের পাঁচ দিন পূর্বে আপনার সাথে এই সকাল বেলাতে হাঁটার সময় সেতু নির্মাণ নিয়ে মিনিট পাঁচেক কথা হয়েছিলো। খুব আনন্দের অনুভূতি সেটা। পৌনে নয় বছর আগে…
-সর্বনাশ! কী বলছো এসব! এত কিছু মনে রাখো কীভাবে? রহস্যটা কী?
-রহস্য তো একটা আছেই। তবে বলতে অস্বস্তি লাগছে। যদি আপনি রেগে যান!
-আরে রাগবো কেন? নির্ভয়ে বলো! আমি জানতে চাই।
-আমি প্রচুর বই পড়ি। এতে মস্তিষ্কের চর্চা হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে। মগজের কোষ গুলো অকালে মরে যায় না।
-হুম।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তবে রাজা ফূর্তিবাজ মানুষ। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারেন না।
-দেখ দেখ! কী সুন্দর একটা পাখি! এই সেদিনও তুমি পাখিটার নাম বলেছিলে। কী যেন নাম তার…
-এটা সুখপাখি মহারাজ।
-ওহ হ্যাঁ, সুখপাখি। মনে থাকবে। কী যেন বললে? সুখ সুখ সুখ পাখি। হু। কী যেন? আবার বলো তো?
-মহামান্য, আপনার চিকিৎসা দরকার। এক ধরণের রোগ আছে, যার কবলে পড়লে সাম্প্রতিক সবকিছু ভুলে যায় মানুষ।
-খামোশ! আমার কোন রোগ হয় নি। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু ভুলোমনা।
-রাগবেন না মহারাজ! অসুখটি যদি শুধু ভুলে যাওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে এত কথা বলতাম না। এটা ভয়াবহ রোগ। ধীরে ধীরে আপনি নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন, আত্মীয় স্বজনের নামও মনে থাকবে না, অস্থিরতা এবং আতঙ্ক বৃদ্ধি পাবে, এক সাথে দুটো কাজ করতে পারবেন না!
-কী বলছো এসব! আমার মধ্যে তো এমন লক্ষণ আছে! তুমি এসব জানো কীভাবে!
-বই পড়ে মহারাজ!
-হুম। এক্ষণি চলো রাজবৈদ্যের কাছে।
রাজবৈদ্য যত্নের সাথে রাজার রোগ বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে অসুখ কেবল প্রাথমিক পর্যায়ে। এর নিরাময় সম্ভব। কিছু ঔষধ দিলেন। কিছু মানসিক চর্চার পরামর্শ দিলেন। এবং বললেন…
-বেশি করে বই পড়বেন মহারাজ। বই পড়লে মানসিক জড়তা অনেকটাই কেটে যায়। নতুন অনেক কিছু শেখা যায়। মস্তিষ্কের মরা কোষ গুলো সজীব হয়ে ওঠে!
আবারও সেই বই! এদের কথা একদম ফেলাও যায় না, এবং রাখাও যায় না। রাজা বড় বিপদে পড়ে গেলেন। উজির তৃপ্ত মনে হাসী গোপন করে গম্ভীর ভাবে বসে রইলেন।
ফেরার পথে সাহস পেয়ে উজির মশাই বিস্তারিত বয়ান শুরু করলেন বইয়ের পক্ষে। কীভাবে বই মানুষকে আকর্ষণীয় এবং জ্ঞানী করে তোলে। কীভাবে বইয়ের প্রভাবে মানুষ হয়ে ওঠে আরো সংস্কৃতিমনা, এবং বিবেচক। বিশ্লেষক এবং সহানুভূতিশীল মন কীভাবে সবার সম্মানের পাত্র হিসেবে গড়ে তোলে, এই ব্যাপারে এক চমৎকার এবং উদ্দীপক বক্তব্য পেশ করলেন তিনি।
পরদিন এক গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে ধ্রূপদী সঙ্গীত শুনতে শুনতে মহামান্য রাজা ঘোষণা করলেন, এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটা তিনি গড়বেন।
হাততালি যা পেলেন তা একটুও মেকি ছিলো না!
প্রিয় পাঠক, বই এভাবেই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রীতিমত ঔষধের কাজ করে। তাই সুস্থ থাকুন সৃজনে বাঁচুন, বই পড়ুন।