পিঁপড়া পৃথিবীর আদিতম প্রাণীগুলোর একটি। ক্ষুদ্রতর প্রাণীর মধ্যেও পিঁপড়া অন্যতম।
কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রাণীর কাছে থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। কর্ম বৈশিষ্টের জন্য এই ক্ষুদ্র প্রাণীটিকে অনেক সময় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পিঁপড়া বহুবিধ গুনে গুনান্বিত। যেমন:
১। দলবদ্ধতা
—————–
পিঁপড়া সব সময় দলবদ্ধ হয়ে চলতে পছন্দ করে। পিঁপড়াদের একাত্মতাবোধ খুব বেশি। খাবার জোগাড় করা বা যেকোন কাজের সময় দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। দলনেতা হলো রানি পিঁপড়া। রানি পিঁপড়াকে মান্য করে চলে সবাই। লাইন ধরে চলাফেরা করে। নিজেদের দুঃখ-কষ্ট পরস্পরের মধ্যে শেয়ার করে।
শীতকালের জন্য খাবার গরমের দিনে কে কতটা জোগাড় করল, আর কতটা জোগার করতে বাকি, তা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়।
২। দূরদর্শিতা
——————
পিঁপড়া ভীষণ দূরদর্শী। সারা বছর পরিশ্রম করে শীতকালের খাবার জোগাড়ের জন্য। শীতকালে ঠান্ডার জন্য খাবার সংগ্রহে কষ্ট হবে বলে সারা বছর খাবার জোগার করে।
বিপদ থেকে বাাঁচার জন্য দল বেঁধে চলাফেরা করে। কোনো বিপদের কথা শুনলে মুহূর্তের মধ্যে সেই তথ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আমরা যদি আমাদের বিপদের দিনের জন্য আমাদের সাধ্যমতো সঞ্চয় করি, তাহলে আমরা উপকৃত হবো। আর জীবনে জয়ী হবার জন্য শুধুমাত্র নিজের বুদ্ধি দিয়ে চললে হবেনা। অন্যদেরও বুদ্ধি পরামর্শ আমাদের কাজে লাগবে।
৩। অক্লান্ত পরিশ্রমী
—————————-
ক্ষুদ্র এই প্রাণী অক্লান্ত পরিশ্রমী। পিঁপড়ার দেহের ওজনের তুলনায় ২০ গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারে।
পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পিঁপড়া রয়েছে। সব প্রজাতির পিঁপড়াই পরিশ্রমী।
আমরা যদি আমাদের মেধার সাথে আমাদের শ্রমকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি তবেই সফলতা সম্ভব। অলস ব্যক্তিরা কখনো সফল হতে পারেনা। তাদের মেধা থাকলেও, পরিশ্রমের অভাবে সবার পেছনে পড়ে থাকে।
৪। দক্ষ সংগঠক
———————-
প্রতিটি পিঁপড়ার মধ্যে রয়েছে নেতৃত্বে দেওয়ার প্রবল মেধা। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, দলের পরস্পরের প্রতি মায়া মমতা, দূরদর্শিতার জন্য মিলিয়ন বছর আগের এই প্রাণী পৃথিবীতে এখনো টিকে আছে। তাদের রয়েছে চরম শৃঙ্খলাবোধ।
তাদের গোত্রের সবার কাজ ভাগ করা থাকে, কেউ অলসভাবে দিন কাটায় না।
আমরা যদি পরিবারের মানুষের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে মিলেমিশে থাকবার চেষ্টা করি, অন্যের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে এর সুফল আমরাই ভোগ করবো। কাকে কখন কাজে লাগবে, আমরা কেউ জানিনা। কার জীবনে কখন কি বিপদ হবে, সব অনিশ্চিত। তাই আমাদের উচিৎ পিঁপড়ার বিদ্যাকে কাজে লাগানো।
৫। উদারতা
—————–
উদারতার অভাবে জগৎ-সংসারে প্রচুর অশান্তি হয়। রক্তের সম্পর্কের আপনজন পর্যন্ত দূরে সরে যায়।
পিঁপড়া সহকর্মীদের প্রতি ভীষণ উদার। একজনের জোগার করা খাবার শর্তহীনভাবে অন্যকে দেয়। দুঃখ-কষ্ট, সফলতা, খাবার পরস্পরের সঙ্গে ভাগ করার প্রবণতা এই প্রাণীদের মধ্যে সত্যিই প্রশংসনীয়।
পিঁপড়ার উদারতার পাশাপাশি শৃঙ্খলাবোধ ভীষণ প্রসংসনীয়।
জীবনে শান্তি নিয়ে বাঁচতে হলে আপনার চারিপাশের মানুষজনের উপকার আপনাকে করতে হবে। অবশ্য সব সময় সম্ভব হয়না। তবে কারো বিপদে অন্তত একটু ভালো কথা বলে সাহস স্বান্তনা দেয়াটাও হতে পারে সেই মানুষের জন্য উপকার।
অন্যের বিপদে ব্যথা অনুভব করার জন্য আপনাকে হতে হবে উদার। উদার চিন্তা চেতনা ছাড়া মানুষ অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারেনা।
৬। সহনশীলতা
———————
পিঁপড়ার দুটি পাকস্থলী। একটি পাকস্থলীতে সে তার খাবার নিজের জন্য আরেকটাতে খাবার জমিয়ে রাখে অন্যদের জন্য।
শর্তহীনভাবে পিঁপড়া তাদের খাবার গোত্রের অন্য পিঁপড়াকে দেয়।
আমরা যদি আমাদের অবশিষ্ট খাবার, পুরোনো কাপড় ফেলে না দিয়ে বা আলমারিতে বন্দী না করে যদি অসহায় মানুষকে দেই, তাহলে অন্তত কিছু মানুষের উপকার হবে।
৭। পরোপকারিতা
————————
পিঁপড়া পরের উপকার করতে প্রস্তুত থাকে। কোথাও কোন মানুষ বা প্রাণী তাদের কাউকে আঘাত করলে বা কোন বিপৎসংকেত তারা পেলে মুহুর্তের মধ্যে অন্য পিঁপড়াকে জানিয়ে দেয়। অন্য পিঁপড়ার উপকার করার জন্য তারা থাকে সর্বদা প্রস্তুত।
একজন কোনো বিপৎসংকেত পেলে তা মুহূর্তের মধ্যে সবার মাঝে ছড়িয়ে যায়। তখন তারা দল ভেঙ্গে ছুটে পালায়। একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যরা তাকে বহন করে, বাসস্থানে পৌঁছে দেয়। সেবা যত্ন করে।
অন্যের উপকার করার মন মানসিকতা আমাদেরও থাকতে হবে। পিঁপড়ার মধ্যে রয়েছে প্রবল গোত্র প্রেম। আমাদের মধ্যেও থাকা উচিৎ দেশপ্রেম। নিজের দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিপ্রেম আমাদেরকে এগিয়ে দেবে কয়েক ধাপ সামনে।
৮। শৃঙ্খলাবোধ
———————
তারা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে লাইন করে চলাফেরা করে। মেঝে, মাঠ বা রাস্তা যেখানেই হাঁটাচলা করে বা খাবার জোগাড় করে, তারা শৃঙ্খলা নিয়ে দল বেঁধে চলাফেরা করে। তাদের দল সমান্তরাল থাকে। এক লাইনে চলতেই থাকে তাদের পথচলা।
০৯। বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকার প্রবণতা
———————————–
পিঁপড়া বৈরী পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট পারদর্শী। শীতকাল তাদের জন্য নিরাপদ নয় বলে তারা গরমকালে জরুরি কাজগুলো সেরে রাখে। যেমন খাবার জোগার, তাদের থাকার নিরাপদ জায়গা ঠিক করা।
শীতকালে যেন কষ্ট না হয় সে জন্য গরমকালে তাদের নিরাপদ বাসস্থান ঠিক করে রাখে। তাদের আক্রমণ না করলে, তারা সাধারণত কামড় দেয় না।
আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরনের পিঁপড়া দেখা যায়। লাল ও কালো। দুই ধরনের পিঁপড়া একই রকম বৈমিষ্ট্যের।
১০। ধৈর্য
————-
ছোট এই প্রাণীর ধৈর্য প্রবল। ধৈর্যের জন্য দীর্ঘ বছর ধরে দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে লাড়াই করে টিকে আছে। বাঘের প্রচন্ড খিদে পেলে সে শিকার করতে না পারলে নিজের সন্তানকে পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। কিন্তু পিঁপড়া কখনোই এই কাজ করে না। ধৈর্য ধরে শীতকালের খাবার গরমকালে সংরক্ষণ করে।
পিঁপড়ার মতো আমাদেরও দরকার ধৈর্য্য। জীবনে কষ্ট আসবেই। আমরা যদি বিপদের দিনে দৈর্য্য ধরার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা বহুবিধ সমস্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি পাবো।
১১। রুটিন মেনে চলে
——————————
ক্ষুদ্র এই প্রাণী রুটিন মেনে চলে। তাদের সবার কাজ ভাগ করে দেওয়া থাকে। তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করে। ক্লান্তি তাদের পেছনে ফেলতে পারে না।
আমাদেরকেও পিঁপড়ার মতো পরিশ্রমী হতে হবে। সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে।
আমরা যদি পরিশ্রম, শৃঙ্খলা আর সততা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারবো।
ফারহানা মোবিন
চিকিৎসক, লেখক ও উপস্থাপিকা