ঘাম দেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ঘামে সাধারণত গন্ধ হয়না। কিন্তু যখন ঘামের সাথে ব্যাকটেরিয়া যুক্ত হয়, তখন ঘামে দুর্গন্ধ হয়।
আমাদের সারা দেহের ত্বকে রয়েছে প্রায় সাঁড়ে চার থেকে পাঁচ মিলিয়ন ঘাম গ্রন্থি। এই গ্রন্থি গুলো ঘাম নিঃসরণ করে। আর এই ঘামের সাথে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ব্যাকটেরিয়া জমে ঘামে দুর্গন্ধ তৈরি করে।
আমাদের ত্বকেও লেগে থাকে অসংখ্যা ব্যাকটেরিয়া। এসব অনুজীব ঘামের লবন পানির সাথে মিশে দুর্গন্ধ তৈরি করে। ঘামের মধ্যে থাকে লবন ও পানি। কয়েক দিন পরিস্কার পরিছন্ন না থাকলে ঘামের সাথে ছত্রাকও যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ তৈরি করতে পারে।
বিদায় নিয়েছে শীত কাল। বাড়তে শুরু করেছে রৌদ্রের তীব্রতা। ভোরবেলাতে ঠান্ডা আর দুপুরে গরম। সেই সাথে উড়ছে ধূলোবালি। অনেকেই ঘাম জমে ঠান্ডা গরম জনিত কাশির শিকার হচ্ছেন। ঘাম নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। আবহাওয়া জনিত কারণ পরিবেশ পরিস্থিতি মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও ঘাম এর পরিমান বাড়তে পারে। ঘেমে যাওয়াটা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু দেহের বিশেষ কিছু কারণে অতিমাত্রায় দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম হয় ।
যেমন:- (১) বয়:সন্ধিকালে কিশোর কিশোরীর দেহের বিভিন্ন ধরনের হরমোনজনিত পরিবর্তন হয় । এই সময়ে অনেকের ঘামে দুর্গন্ধ হয়।
(২) অনিয়ন্ত্রত ডায়াবেটিস উচ্চ মাত্রার ফ্যাটি লিভার কিডনীর জটিলতা, ছত্রাক ত্বকের অসুখ উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ঘেমে যাবার সম্ভাবনা থাকে তুলনা মূলক ভাবে বেশি । এবং এই ধরনের রোগীদের রোগ প্রতিরোধ শক্তিও কমতে থাকে। তখন ঘামের সাথে ব্যাকটেরিয়া জমে গন্ধ তৈরি হয়।
(৩) অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, কোন ওষুধের পাশর্^প্রতিক্রিয়া, রান্না ঘরে চুলার তাপের কাছে দীর্ঘ সময় কাজ করা, ক্যান্সার বা কেমোথেরাপি পাচ্ছেন এই ধরনের পরিস্থিতিতে ঘাম ও দুর্গন্ধ দুটোই বাড়তে পারে।
(৪) যাদের শরীরে লোমের পরিমান বেশি এবং দীর্ঘ সময় বাসার বাইরে কাজ করতে হয় নিয়মিত গোসল করার সুযোগ থাকে না, পেশাগত পোশাক দীর্ঘ সময় যাবৎ পরতে হয়, এই ধরনের পরিস্থিতিতে ঘামের সাথে দ্রæত অনুজীব মিশে যায়।
(৫) পোষ্ট মেনোপোজাল লেডীদের (যাদের মাসিক চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে) কিছু হরমোনের তারতম্য এবং অনেকের হষ্ট ফ্ল্যাশ হয়। তখন অতিরিক্ত ঘাম হয়।
(৬) অনেকের হরমোনজনিত অসুখ এবং কিছু ওষুধের পাশ^প্রতিক্রিয়াতে অতিমাত্রায় ঘাম হয়।
(৭) অতিমাত্রায় কফি, অ্যালকোহল, হৃদরোগে অনেকেই ঘেমে যায়।
ঘামের দুর্গন্ধ দূর করার উপায়
(১) নিয়মিত সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। এ্যান্টি ব্যাকটেরিয়ান সাবান; গোসলের পানিতে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ডেটল বা স্যাভলন মিশিয়ে গোসল করা উচিৎ। নিম পাতা সেদ্ধ করে অথবা গোলাপের পাপড়ি গোসলের পানিতে মিশিয়ে দিলে নিম পাতার রস ত্বকের ব্যাকটেরিয়া সহ বিবিন্ন অনুজীবকে ধ্বংস করবে। আর গোলাপের পাপড়ি সুন্দর ঘ্রাণ ছড়াবে।
(২) বাইরের পোশাক নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। নিয়মিত সুযোগ না হলে বাসার বাইরে থেকে এসেই কাপড় রৌদ্রে বা বাতাসে মেলে দিতে হবে। মাঝে মাঝে কাপড় ডেটল বা স্যাভলন দিয়ে পরিস্কার করতে হবে।
(৩) দেহের লোম নিয়মিত পরিস্কার করেতে হবে। লোমের গোড়াতে খুব দ্রæত ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। দেহের যেসব স্থানে আলো বাতাস পৌছাতে পারেনা, সেসব জায়গা নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
(৪) সালফার জাতীয় খাবার যেমন: পেঁয়াজ, রসুন, লালচে মাংস, গ্রীল মাংস অতি মাত্রায় কোমল পানীয়, অ্যালকোহল নিয়মিত খেলে ঘামে দুর্গন্ধ হয় তীব্র । এই জন্য নিজের দেহের ধরন বুঝে বডি স্প্রে, ডিওডোরেন্ট, এ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল সাবান ব্যবহার করতে হবে।
(৫) গরমে সহজে হজম হয় এ ধরনের খাবার খেতে হবে। আরাম দায়ক পোষাক পরতে হবে। নিয়মিত দেড় থেকে দুই লিটার পানি খাওয়া উচিত। এতে দেহের তাপমাত্রার সাম্যাব¯া’ বজায় থাকবে।
(৬) অনেকের হাত পায়ের তলা প্রচুর ঘেমে যায়। সুযোগ হলে হাত ধুয়ে ফেলবেন। অন্তর্বাস, মোজা নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। স্কুল কলেজ বা কর্মসংস্থানে নিয়মিত চামড়ার জুতো ব্যবহার করতে হলে, মাঝে মাঝে জুতো রৌদ্রে দিতে হবে। এত জুতোর ভেতরে জমে যাওয়া রোগ জীবানু মারা যাবে। একই জুতো বার বার ব্যবহার না করে, কয়েক জোড়া জুতো ব্যবহার করতে হবে। অতিমাত্রায় দুর্গন্ধ যুক্ত ঘাম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
(৭) হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপো বা হারপার থাইরয়ডিজম (ঞযুৎড়রফরংস), সিষ্টেমিক লুপাস ইরাইথ্রোম্যাটাস, পলিসিষ্টিক ওভারীয়ান সিনড্রোম, এই ধরনের রোগীদের হঠাৎ অতিমাত্রায় ঘাম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
(৮) অতিমাত্রায় মেকআপ বা হেয়ার ড্রায়ার যাদেরকে ব্যবহার করতে হয় তারা বাসাতে মেক আপ বিহীন থাকার চেষ্টা করবেন।
(৯) মসুর ডাল বাটা, আটা ময়দা, চালের গুড়ো, মেথি বাটা গোসলের সময় সাবানের মতো করে মাঝে মাঝে ব্যবহার করলে ত্বকের রোগ জীবানু, মরা চামড়া গুলো পরিস্কার হয়ে যাবে। দুর্গন্ধও কমবে।
(১০) নিয়মিত টাটকা রঙিন শাকসবজি, ফল, কাঁচা সালাদ খাওয়ার পরিমান বাড়াতে হবে। এতে ত্বকের উজ্জলতা ও রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
ডা: ফারহানা মোবিন,
এম.বি.বি.এস, এম.পি.এইচ (পাবলিক হেলথ্), সি.সি.ডি, সি কার্ড,
পি.জি.টি (গাইনী এন্ড অবস),
মেডিকেল অফিসার
গাইনী এন্ড অবস
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল, ঢাকা।