আব্বার সরকারী চাকুরি করার সুবাদে আমরা আব্বার সাথে যশোরে থাকতাম। আমরা সরকারী বাসায় না থেকে বাইরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। ছয় ভাইবোন সবাই স্কুলে পড়ি। আব্বার অফিস টাইম আর আমাদের স্কুলের টাইম কাছাকাছি সময় হওয়াতে আমরা ছয় ভাইবোন আব্বার সাথে অফিসের গাড়িতে করেই স্কুলে যেতাম।
আমরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। বড় আরাফাত ভাইয়া পড়ে মাত্র এইটে। আপু সেভেনে, আমি সিক্সে সবার ছোট ইমতিয়াজ পড়ে টুতে। মাঝখানে দুই বোন একই সাথে ফাইভে।
এক সকালে আমরা সবাই অফিস বাসে করে স্কুলে রওনা হয়েছি। আব্বার কোলে ইমতিয়াজ। হঠাৎ মাঝপথে আব্বা বুকে হাত দিয়ে বলছেন প্রচন্ড ব্যথা করছে। ইমতিয়াজকে কোলের থেকে নামিয়ে দিলেন। আব্বার ব্যথা আরো বাড়ছে। আমি ছিলাম আব্বার পাশে। আব্বা শুধু বললেন, সোহেল বুকে খুব ব্যথা করছে। এইটুকু কথা বলতে বলতেই আব্বা আমার কোলে ঢলে পড়লেন। গাড়িতে অন্যান্য যেসব কাকারা ছিলেন সবাই আব্বার কাছে আসলেন। গাড়ি ঘুরিয়ে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। আমরা ভাই বোনেরা সবাই আব্বার সাথে হাসপাতালে নেমে গেলাম। আমরা হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে সবাই কান্নাকাটি করছি।
আম্মাকে আনতে লোক পাঠানো হলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আম্মা চলে আসলেন। এর কিছুক্ষন পর ডাক্তার আম্মাকে ডেকে নিয়ে বললেন আব্বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।উনাদের আর কিছু করার ছিল না , আব্বা মারা গেছেন ।আমরা তখনও হার্ট অ্যাটাক কি জানতাম না।
দুই ঘন্টা আগেও আব্বা আমাদের পাশে ছিলেন, আর এখন বলছেন নেই,আমরা ভাই বোনেরা কান্না ভুলে অবাক হয়ে আব্বার নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
অফিস থেকেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে আব্বাকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। সাথে আব্বার কয়েকজন কলিগও এসেছেন। আমার দাদা দাদী তখনও বেঁচে আছেন। দাদা দাদীর বুক ফাটা কান্নায় সারা গ্রামের মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। রাতেই জানাজা পড়ায় আব্বাকে আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হলো।
সাত দিন পর আমরা আব্বাকে ছাড়া যশোর ফিরে আসলাম। আব্বাকে ছাড়া পুরো বাসা খা খা করছে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। আব্বা আমাদের পড়াশুনা করাতেন। এখন বই নিয়ে বসতেও মন চায় না। এভাবে মাস কেটে গেল। আম্মা খেয়াল করলেন আমরা সব ভাইবোন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি। আম্মা নিজের কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে সংসারের হাল শক্ত করে ধরলেন। কলেজের এক ভাইয়াকে ঠিক করলেন আমাদের পড়ানোর জন্য। আমরা নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম।
আমরা যেহেতু সবাই ছোট আর আম্মাও বেশী পড়াশুনা করে নাই। তাই কাউকেই অফিস থেকে চাকুরির কোন ব্যবস্থা করে দিতে পারে নাই। কয়েক মাসের মধ্যেই আম্মা এককালীন টাকা পেয়ে গেলেন।আর মাসে মাসে অল্প কিছু পেনশনের টাকা। আমরা যদি ভাড়া বাসায় থাকি তাহলে এই টাকায় বেশি দিন চলতে পারবো না।
দাদা, চাচা কাকুদের সাথে পরামর্শ করে আম্মা আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার পর বাড়ি চলে আসলেন। পেছনে ফেলে রেখে আসলাম আব্বার প্রিয় অফিস। আমাদের স্কুল বন্ধু বান্ধব সব কিছু। আর কি কখনো আসা হবে এই জায়গায়, দেখা হবে পুরোনো বন্ধুদের সাথে?
দাদা জায়গা দিয়েছেন। আম্মা এককালীন টাকা যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে কোন রকমে টিন দিয়ে দুই রুমের একটা ঘর, ছোট একটি রান্না ঘর আর চাকের একটি টয়লেট ও টিউবওয়েল দিতেই শেষ হয়ে গেল।
আব্বা থাকতে আমরা কি সুখ ভোগ করেছি। এই বয়সই যে এমন হবে আমরা বুঝতেই পারিনি। আব্বা বেঁচে থাকতে আমার মাথায় কোন দিন আসে নাই এমন দিনের কথা। এখন বুঝতে পারছি বাবা যে মানুষের জীবনে কত বড় বটবৃক্ষ। আমার মা শুধু রান্না করত খাওয়া তো সেই মানুষটি আজকে একা ছয়টি ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের ভালো মন্দের খোঁজ খবর শক্ত হাতে রাখছেন। আমরা সবাই গ্রামের স্কুলে ভর্তি হলাম।
প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগত।বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দুই মাইল দূরে। আমরা হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করতাম। একটি মাত্র হারিকেন ছিল। সেই একটি হারিকেনের চারপাশে আমরা ভাই বোনেরা পড়তে হতো। আল্লাহর রহমতে আমরা সব ভাইবোন পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলাম। আরাফাত ভাইয়া আর জুঁই আপু আমাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। ভাইয়া ভালো ছাত্র হওয়াতে স্কুলের স্যাররা ভাইয়ার অনেক খোঁজ খবর রাখতেন।ভাইয়া যেটা বুঝতেন না স্যারদের বললে উনারা খুব সুন্দর করে ভাইয়াকে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু ইমতিয়াজ ছোট হওয়াতে এত হাঁটতে পারত না। আমরা ভাই বোনেরা তারে কোলে পিঠে করে নিতাম।
ভাইয়া আর আম্মা মিলে প্রতিমাসে ঢাকা গিয়ে রেশন নিয়ে আসতেন। তারপরও আমাদের অনেক কষ্ট হতো। আমরা কেউ কোন টু শব্দ করতাম না আম্মা মনে কষ্ট পাবে ভেবে। তখন হয়তো সব কিছু সস্তা ছিল কিন্তু মানুষের হাতে টাকা ছিল না। আম্মা হাঁস, মুরগী পালতেন। শাক সবজি লাগাতেন। আম্মার একটা সেলাই মেশিন ছিল। আশে পাশের মহিলাদের কাপড় সেলাই করতেন।এই টাকা দিয়ে আম্মা আমাদের বই খাতা কলম পেন্সিল কিনে দিতেন। এত কিছুর পরেও আম্মা একা অনেক হিমশিম খেয়ে যেতেন।
আব্বা বেঁচে থাকতে আমরা প্রতি ছুটির দিনে পোলাও মাংস খেতাম। এখন আম্মার জন্য এটা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বকুলটা বুঝতে চায় না। ছুটির দিনে আম্মা পোলাও করে দেন, আম্মা পোলাও করে দেন বলে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। আম্মা রেশনের চাল দিয়ে পোলাও করেন।হয়তো সেদিন জমানো ডিম গুলো বিক্রি না করে আমাদের জন্য রান্না করেন। রেশনের চালের পোলাও আমরা এত মজা করে খাই, মনে হয় স্বর্গের খাবার খাচ্ছি।
দাদা দাদী আব্বার শোকে বেশী দিন বাঁচলেন না। কিছু দিন আগ পিছ দুজনই মারা গেলেন। আমার চাচা, কাকু, ফুফু বা মামার বাড়ির দিকের মানুষ এমন কোন টাকা পয়সাওয়ালা ছিল না যে আমাদের সাহায্য করবেন। আম্মাও কাউকে কখনো টাকা পয়সার কথা বলতেন না।
আমাদের বাজারে আব্বার ছোট বেলার বন্ধু মতি কাকুর দোকান ছিল। আমরা যেদিন প্রথম দিন গ্রামে চলে আসলাম কাকু আমাদের বাড়ি এসে বলে গেলেন যা লাগবে আমরা যেন কাকুকে জানাই। যখন কোন উপায়ই আর থাকতো না তখন আম্মা আমাদের উনার কাছে পাঠাতেন। পরে টাকা হলে আম্মা শোধ দিয়ে দিতেন।
দেখতে দেখতে ভাইয়ার মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় হয়ে গেল। আম্মা এত টাকা একসাথে কোথায় পাবেন, চিন্তায় অস্থির। মতি কাকু সব টাকা দিলেন। আম্মা পরে আস্তে আস্তে শোধ করলেন। আমাদের সব রকমের সাহায্যে মতি কাকু আপনের মত এগিয়ে আসতেন।
সময় তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। কারো সুখের দিকেও তাকায় না, দুখের দিকেও না। সে চলে তার আপন গতিতে। সুখ দুঃখ মিলিয়ে আমাদের জীবন চলতে থাকে। ভাইয়া মেট্রিক, ইন্টারে স্টার পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হলো। জুঁই আপু ইউনিভার্সিটি,আমি খুলনা বিআইটিতে। শিমুল বকুল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ইমতিয়াজ টেনে। সেই সময় আম্মার সাথে আমাদের সব আত্মীয় স্বজন যে যতটুকু পেরেছে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। কিন্তু মতি কাকুর কথা লিখে প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই। কাকুর পড়াশুনার প্রতি এত টান, অথচ উনার ছেলে দুটো এইট নাইনে উঠার পরই পড়াশুনা ছেড়ে দিল। মেয়ে তিনটেও পড়াশুনায় তেমন ভালো ছিল না বিধায় বিয়ে দিয়ে দিল।
ভাইয়া ডাক্তার হওয়ার এক বছরের মধ্যে সৌদি আরব চলে গেলেন। আমাদের সংসারের অভাব দূর হয়ে গেল। জুঁই আপুরও বিসিএস হয়ে গেল। আমি জার্মান চলে আসলাম। মানিকজোড় শিমুল বকুল দুজনেই সরকারী হাইস্কুলের শিক্ষক। কিন্তু সবচেয়ে বড় বাজিমাত দেখিয়েছে আমাদের ছোট ইমতিয়াজ। সে ইউনিভার্সিটির গোল্ড মেডেল পেয়েছে এব্ং সে ইউনিভার্সিটির টিচার।
বড় ভাইয়া হয়তো দুই এক বছর পর পর বাংলাদেশে আসনে তখন আমরা যেখানেই থাকি না কেন সম্ভব হলে সবাই আসি।এতে আম্মা খুব খুশি হন। আমাদের ভাই বোন যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতাম, এই সব গাড়ি মতি কাকুর দোকানের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতে হত। এটা ছিল আম্মার আদেশ। আমরা যেন পেছনের কথা ভুলে না যাই সেজন্য আম্মা এরকম আদেশ দিয়ে রেখেছেন। আম্মা গ্রামের কারো কোন সমস্যা হলে আমাদের ছয় ভাইবোনকে জানান। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করি আম্মার কথা রাখার। আম্মার কথায় বড় ভাইয়া অনেক লোক সৌদি আরবে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এর মধ্যে মতি কাকুর দুই ছেলেও আছেন।
বড় ভাইয়া বাড়ি আসলে খুব আনন্দ হয়। বড় ভাইয়া বাড়ি আসার আগেই সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয় ভাইয়া আসবে। সবাই যেন ভাইয়া আসার অপেক্ষায় রোগ পুষে রাখে। ভাইয়া যে কতদিন থাকেন প্রতিদিন রুগি আসে ভাইয়া সাধ্যমত রোগি দেখার পাশাপাশি ঔষধ দিয়ে দেন। আর আমরা দেখি আম্মার সুখী সুন্দর মুখটি। যে মুখ টা এক সময় সারাদিন ছেলে মেয়ের চিন্তায় অস্থির থাকত।সেই মুখটা আজকে আনন্দে ঝলমল করে। দেখতে কি যে ভালো লাগে। আমরা সবাই আসলে আম্মা অনেক রসগোল্লার অর্ডার দেন। আম্মা হাসি মুখে যে আসে তাকেই দুটি করে রসগোল্লা খেতে দেন।
লেখক–
আফরোজা (মুন্নি)
ঢাকা, বাংলাদেশ