করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন খুব দ্রুত আবিস্কার হয়ে গিয়েছিল। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা এই টিকা নিতে পেরেছি। কিন্তু সারা পৃথিবীতে এখনো যে মহামারীটির ভ্যাকসিন আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি, সেই মহামারীটির নাম হলো ডায়াবেটিস।
পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে ডায়াবেটিসের রোগী নেই। আমাদের দেশে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, প্রাথমিক পর্যায়ে অধিকাংশ ডায়াবেটিক রোগীর ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো সহজে ধরা পড়েনা।
একটু দেরী করে লক্ষণগুলো বোঝা যায় বা পরীক্ষা করলে রোগ ধরা পড়ে। সমস্যা হলো প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কষ্ট হয়না বলেই মানুষ সচরাচর পরীক্ষা করায় না।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে একজন ডায়াবেটিক রোগী একজন নন ডায়াবেটিক রোগীর মতোই কাজ করতে পারবেন। কিন্তু বছরের পর বছর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে তা হয়ে ওঠে নীরব ঘাতক। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অবশ্যই ডায়াবেটিক রোগীকে নিয়মিত রক্তে চিনির মাত্রা মাপতে হবে। ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সেই মোতাবেক চলতে হবে।
কাউকে ওষুধ খেতে হয়, কেউবা ইনসুলিন ইনজেকশনের জন্য উপযোগী। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকার ডায়েট, ডিসিপ্লিন এবং ড্রাগ বা ওষুধ। রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধও লাগে না। তাই চেষ্টা করতে হবে রক্তে চিনির মাত্রা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যাবার নামই ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস বছরের পর বছর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃৎপিন্ড, কিডনী, চোখ, সারা দেহের স্নায়ুগুলোর উপর পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। পুরো দেহের সকল অংগ দুর্বল হয়ে পড়ে। রক্তে বেড়ে যায় ইনফেকশানের মাত্রা।
এই ইনফেকশানের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অবশ্যই রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের দেহের কেথাও কেটে গেলে বা ঘা হলে সেটা শুকাতে সময় লাগে নন ডায়াবেটিকদের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি।
তবে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পরিমাণটা কমে আসে। আমাদের পেটের মধ্যে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় নামে এক ধরণের অংগ রয়েছে। এই অংগ থেকে ইনসুলিন নামের একধরণের হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনটা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যায়। ইনসুলিন হরমোনের কাজ হলো রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে দেয়া।
ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন হরমোন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না বা দেহে সঠিকভাবে তৈরী হয় না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার পরেও যদি খাদ্যাভাস, জীবন যাপন পদ্ধতি সঠিকভাবে মেনে চলা যায়, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকা যায়, তাহলে অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
অনেক রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার পরেও তিনি কোন ধরণের সমস্যা অনুভব করেন না, এই জন্য তিনি রক্ত পরীক্ষা করান না, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করেন না। এমনটা কখনোই উচিৎ নয়। কোন ধরণের শারীরিক সমস্যা না থাকলেও ডায়াবেটিক রোগ বেড়ে যেতে পারে। এই জন্য ডায়াবেটিক রোগীদেরকে অবশ্যই নিয়মিত রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এবং নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে।
অনেক সময় রক্তে চিনির মাত্রা বেশি হবার পরেও শারীরিক কষ্ট নাও থাকতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা হয়ে উঠবে আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ ডায়াবেটিক রোগীকে দেখে বোঝা যায়না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দীর্ঘ বছর পরে অনেকের চেহারা খারাপ হয়ে যায়, ওজন কমে যায়।
কিন্তু রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে থাকলে তা ঘুণে ধরা পোঁকার মতো পুরো দেহকে দুর্বল করে দেয়।
এই জন্য নিয়মিত রক্তে চিনির মাত্রা পরিমাপের পাশাপাশি প্রতি বছর বা ছয় মাস পর পর পুরো দেহের চেক আপ করানো ভীষণ জরুরী।
পুরো দেহের সম্ভব না হলেও কিছু জরুরী পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর দরকার। তাহলে ডায়াবেটিস এর জন্য অন্যান্য অংগগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলো কিনা ধরা পড়বে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে চোখের রেটিনা সহ চোখের অন্যান্য অংশগুলোও দুর্বল হয়ে যায়। তাই চোখের চেক আপও ছয় মাস পর পর ভীষণ জরুরী। সম্ভব না হলে প্রতি বছর চেক করাতে হবে।
আর বর্তমান যুগ হলো প্রযুক্তি নির্ভর। আমাদেরকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবের স্ক্রীনের উপর চোখ রাখতে হয় দীর্ঘ সময়। এতে চোখের পাওয়ার এর পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। যারা ডায়াবেটিক রোগী তাদেরকে সচেতন হতে হবে আরো বেশি।
নিয়মিত চোখ ও সারা দেহের চেকআপ করাতে হবে। পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খাবার নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম ভীষণ জরুরী। দীর্ঘ বছর ডায়াবেটিস থাকলে রক্তনালীগুলোও দুর্বল হয়ে যায়। অতিরিক্ত তেল, চর্বি যুক্ত খাবার খেলে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে, তখন চর্বি রক্তনালীতে জমতে শুরু করবে। প্রথম কয়েক বছর হয়তো কোন সমস্যাই হবে না। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী এইভাবে রক্তনালীতে চর্বি জমতে থাকলে, হৃৎপিন্ডের শিরা-উপশিরাতে রক্ত সঠিকভাবে চলাচল করতে পারবেনা। তখন তৈরী হবে হৃদরোগ। বেড়ে যাবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে দাঁতও খুব দ্রুত বিভিন্ন ধরণের অসুখে আক্রান্ত হয়। সম্ভব হলে প্রতি বছর দাঁতের স্কেলিং করাত হবে অথবা দাঁতেরও চেকআপ করানো দরকার। ডায়াবেটিক ফুট ডায়াবেটিসের রোগীদের পায়ের একধরণের অসুখ। পায়ের নীচে কোথাও মাংসপেশী শক্ত হয়ে গেছে কিনা বা পায়ের কোন আঙুল এ যদি স্পর্শ করলে কোন অনুভূতি পাওয়া না যায় এবং এই সমস্যা যদি বার বার অনুভুত হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকলে এবং শারীরিক কোন সমস্যা না থাকলেও দেহের সব অংগের উপরে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখাটা অপরিহার্য্য।
ডা. ফারহানা মোবিন,
মেডিকেল অফিসার, গাইনী- অবস ইনফারটিলিটি এন্ড গাইনী অনকোলজি ডিপার্টমেন্ট,
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল, ঢাকা।
বিএমডিসি রেজি নং – এ ৫৯১৮২