ফুটবল বিশ্বকাপের জোয়ারে এখন সারাদেশ ভাসছে। আর সেই জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে ছোটবড় বহু ঘটনা দূর্ঘটনা। চট্টগ্রামের রাইফা প্রায় আড়াই বছর বয়সের ফুটফুটে ছোট্ট একটি মেয়ে। টুকটুক করে হেটে বেড়ায়, নিজের মত খেলা]করে, সারাটাদিন মায়ে সাথে কত গল্প, আর বাবা এলে বাবার কোলে উঠে শিশুমনে অজস্র প্রশ্ন। গত শুক্রবার সামান্য গলা ব্যথার কারনে ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নিতে ছুটে গেলে, ডাক্তার শিশুটিকে নগরের মেহেদিবাগে অবস্থিত ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেয়। শুক্রবার রাত ৯টার সময় সেই সামান্য গলা ব্যথা নিয়ে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রাইফার লাশ সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় বাবার কোলে তুলে দেওয়া হাসপাতাল কতৃপক্ষ। কি মর্মান্তিক কি নির্মম ঘটনা।
ডাক্তার বা হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছে ঘটনাটি হয়তো কিছুই না। সাধারন একটি শিশু মরে গেছে, এ আর এমন কি! কত শিশুই তো দেশে মরছে প্রতিদিন তাই না। ঠান্ডা জনিত গলা ব্যথার কারনে হাসপাতালে ভর্তি বিষয়টি হয়তো সন্দেহ জনক নয়, হয়তো বিষয়টি তারচেয়ে একটু বেশি। যদিও আমি চিকিৎসক নই, তবে দু-দুটি সন্তান লালন পালন করার অভিজ্ঞতা আছে। অভিজ্ঞা আছে শত শত রাত জেগে থাকার, জ্বরে পুড়ে যাওয়া সন্তানকে এরকম গ্রীষ্মকালে বুকে নিয়ে পায়চারি কে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করার। আমার অভিজ্ঞতা আছে ডাক্তারের দেওয়া তিতা বিষ ঔষধ চিনি মিশিয়ে সন্তানদের খাওয়ানোর।
তাই বলতে পারি এই গ্রীষ্মে শিশুদের গলা ব্যথার কারন ঠান্ডা পানি বা আইসক্রিম হতে পারে। যা একজন ভাল ডাক্তার খুব যত্ন সহকারে সারিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু তা না করে গলা ব্যথার উপসর্গ খুজতে একগাদা টেষ্ট এবং হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেশের একজন ডাক্তার এখন দিতেই পারে। কারন সেটা তার ব্যক্তিগত মন-মর্জি আর কমিশনের ব্যাপার। যেহেতু চিকিৎসা নিতিমালা এ দেশে কেউ অনুসরন করে না বা জানে না তাই এই সুযোগ একজন চিকিৎসক নিতেই পারে। এদেশে যদিও একজন ডাক্তারকে আরেকজন ডাক্তারের সুনাম করতে খুব কম দেখা যায়। তথাপি বাংলাদেশের চিকিৎসকরা মারাত্মক রকমের সঙ্ঘবদ্ধ, রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও কর্মজীবনে তাদের মধ্যে কোন দলভেদ বা গত্রভেদ নেই, তারা চিকিৎসক এদেশে ঈশ্বরের পরেই তাদের অবস্থান।
এদেশে ডাক্তারের অবহেলায় মৃত্যুর দায়ভার সাধারনত পরিবার পরিজনদের ঘাড়ে এসে পড়ে। বংলাদেশে ডাক্তাররা কখনও চিকিৎসায় অবহেলা করেনা। অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারনে আজ পর্যন্ত কোন ডাক্তারের দৃষ্টান্ত মূলক সাজা হয়েছে বলে আমার জানা নাই। তাই বাংলাদেশের ডাক্তারদের ভাষায় বলা যেতে পারে এদেশের চিকিৎসকরা অন্য যে কোন দেশের চিকিৎসকদের চেয়ে বিচক্ষণ। কয়েক মাস আগে দেশের বড় এক পত্রিকায় পড়েছিলাম বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বহুগুন কমে গেছে। এও কি বিশ্বাস করার মত কথা, কত টাকার বিনিময়ে একটি বড় পত্রিকা এধরনের বিভ্রান্তি মূলক সংবাদ প্রকাশ করতে পারে। তারপরও এদেশে ডাক্তারের অবহেলায় মৃত্যু হয় এবং হচ্ছে। কিছু কিছু মৃত্যু প্রকাশ্যে আসছে কিছু গোপন থেকে যাচ্ছে। যে সকল মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ হয় সেগুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়ধামাচাপা পড়ে যায় অজানা কারনে। যারা বা যাদের কারনে মৃত্যু হচ্ছে তারা সব সময় ধরা ছোয়ার বাহিরে থেকে যাচ্ছে। আর স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে চরম ঘৃণা নিয়ে পরিবার পরিজনের বাকিটা জীবন কেটে যায় না পাওয়া বিচারের প্রতিক্ষায়।
বাংলাদেশে কোন চিকিৎসকের নামে অভিযোগ করলে তদন্ত কমিটি হয় ঠিকই, কিন্তু তদন্ত করে তাদেরই কোন না কোন সহকর্মী, যে অভিযুক্ত ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করতে নিয়মে বড় বড় ফাঁক রাখে দেয়। কারনটা হচ্ছে কোন এক সময় তদন্ত কারি সেই চিকিৎসকেরও ভুল হয়ে যেতে পারে। তখন সে আজকের গুনে বেঁচে যাবে তার সহকর্মীর মত। এছাড়া ঘটনাক্রমে কখনও যদি দেশের কোন চিকিৎসকের নামে মামলা হয়, তাহলে সেই মামলার কারনে সারাদেশে যেন নরকীয় অবস্থা নেমে আসে। সহকর্মী চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি দিয়ে দেশের সবকটা সরকারি হাসপাতাল অচল করে দেয়, চিকিৎসকদের আন্দলোন চলতে থাকে মামলা তুলে না নেওয়া পর্যন্ত। মামলার বাদি পক্ষ বাধ্য হয় তখন মামলা তুলে নিতে। মামলা যখন তাদের প্রিয় মানষটিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না, আর এই মামলার কারনে অন্য গুরুতর অসুস্থ রোগি যদি চিকিৎসা অভাবে মৃত্যু হয় সে দায়ভার তাদের ঘাড়ে পড়ার অনুতাপে। আবার কখনও কখনও প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে আপোষ মিমাংসা হয়। এই হচ্ছে দেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত ঘটে যাওয়া অনেক গুলো ঘটনার মোটামোটি একটা চিত্র।
রাইফার বাবা সমকাল পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর ক্রাইম রিপোর্টার রুবেল খান, আমিও একই পেশায় নিয়োজিত। সাংবাদিক রুবেল খানের পরিবারের প্রতি সহানুভূতির কারনে লিখছি না, লিখছি গত শুক্রবার রাইফার পরিবারের উপর যে কালোঝড় বয়ে গেছে তা যেন আমাদের মত আর কাউকে সইতে না হয়। সব জায়গায় শুনি দেশে জনসংখ্যার চেয়ে ডাক্তার অনেক সিমিত। অথচ দেশের জেলা শহর গুলোতে কোথাও বিশেষজ্ঞ চিকিৎকদের অভাব দেখিনা। দেশের মানুষ গিনিপিগ না রক্তমাংসের জীবিত মানুষ এটা ডাক্তাররা বারবার ভুলে যায়। তাদের সঙ্ঘবদ্ধতার কারনে তাদের উপর দেশের কোন আইন কাজ করে না, এদেশে ডাক্তাররা যেন আজ পর্যন্ত সবকিছুর উর্ধে।
আমার অনুরোধ সংবাদকর্মী সকল সাংবাদিক ভাই ও বোনদের কাছে, উন্নত চিকিৎসার নামে যে সকল ডাক্তার নিরিহ মানুষের মৃত্যুর বানিজ্যের সাথে জড়িত এদের মুখোশ খুলে ফেলুন। পর্যাপ্ত স্বাক্ষ-প্রমান সংগ্রহ করে শুধুমাত্র সাংবাদিকরাই পারে এদের মৃত্যুর বানিজ্য বন্ধ করতে, এদের বিচারের আয়তায় আনতে। মরিচিকার পেছনে না ছুটে দেশের মানুষকে প্রকৃত ঘটনা অবগত করাই একজন সাংবাদিকের পরম ধর্ম। ফুটফুটে রাইফা চলে গেছে বাবা-মায়ের বুক খালি করে, আমরা তার জন্য কি কিছুই করতে পারি না। অবহেলা বা অপচিকিৎসায় তার মত আর কোন বাবা-মায়ের বুক যেন শুন্য না হয়। আর কোন বাবা-মায়ের বুক না ভাসে অষ্যুর সাগরে। জাগো সাংবাদিকেরা জাগো, ‘সেবাই ধর্ম’ ব্রত গ্রহন করে ব্যবসাকে ধর্মে পরিনত করা দেশের সেই সব চিকিৎসকদের ব্যবসা দ্রুত বন্ধ করতেই হবে আমাদের।
লেখক-আজাদ জয়