Menu |||

জীবন নদীর বাকেঁ ”গল্প”

আমি সোহেল। আমার বড় এক বোন পাপিয়া।আর ছোট এক ভাই আরাফাত। আমাদের গোছালো সংসার। মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনটি সন্তান নিয়ে যেমন থাকা যায় তেমন আমাদের পরিবার। অর্থের সচ্ছলতা না থাকলেও কোন দিন অভাবকে প্রশ্রয় দেয়নি আমার আব্বা। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের চাওয়াকে পূরণের চেষ্টা করেছেন আব্বা। ও বলা হয়নি আমার আব্বা কাপড়ের ব্যবসা করেন। আব্বা বাবুরহাট থেকে কাপড় নিয়ে সিলেট আর চট্টগ্রামে পাইকারী দামে বিক্রি করেন। তাতেই আমাদের লেখাপড়া সহ সংসার সুন্দর ভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের একটাই সমস্যা। আমার আম্মা কারো সাথেই ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। ভালো কথা থেকেও আম্মা ঝগড়া শুরু করেন। যার জন্য দাদা,দাদি, চাচা, ফুফু, পাড়াপ্রতিবেশী আমাদের এড়িয়ে চলেন। এমন কি আম্মার এই স্বভাবের জন্য নানা বাড়ির মানুষ জন‌ও আম্মাকে ভয় পায়।আমরা ভাই বোনেরা আম্মাকে ভীষন ভয় পাই।

 

পড়াশুনা ঠিক মতো না করলে বা পরীক্ষায় কোন কারনে খারাপ করলে আমাদেরকে তো মারতেন‌ই যে স্যার আমাদের তিন ভাই বোনকে বাসায় পড়াতেন তার উপর দিয়েও ঝড় ব‌য়ে দিতেন। একমাত্র আব্বা আম্মার সাথে কিভাবে যেন মানিয়ে চলেন। আব্বার শান্ত স্বভাবের কারনেই কিনা আম্মার সাথে কখনোই কথা কাটাকাটি হতে পর্যন্ত দেখিনি। আব্বা প্রতিবার সিলেট বা চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে আমাদের থেকেও বেশী আম্মার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যান, কারো সাথে যেন ঝগড়া বিবাদ না করে, ভালো ভাবে যেন সবার সাথে মিলে মিশে চলেন। কিন্তু আব্বা বলে যাওয়া পর্যন্তই।একদিক দিয়ে আব্বা বের হয়ে যান আরেকদিকে আম্মা তার স্বরূপে ফিরে যান। একদিন কাক ডাকা ভোরে খবর আসলো আব্বা যে বাসে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি আসছিলেন সেটা কুমিল্লার কাছে এক্সিডেন্ট করেছে। এ খবর শুনেই বাড়ি থেকে দুই কাকু র‌‌ওনা হয়ে গেলেন।

 

সন্ধ্যায় দুই কাকু আব্বার লাশ নিয়ে আসলেন। বাড়ির মধ্যে কান্নার রোল উঠলো। কিন্তু আম্মা সেই যে চুপ হলেন আর মুখ খুললেন না। আব্বা তেমন কিছুই আমাদের জন্য রেখে যেতে পারেন নি। অল্প কয়েক মাস কোন রকমে চলছে। আমাদের লেখাপড়া দূরে থাক খাবার জোগাড় করাই কষ্ট হয়ে পড়ছে।দাদা বাড়ির কেউই আম্মার স্বভাবের কারনে আম্মাকে দেখতে পারত না। নানা বাড়িতেও যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। এত গুলো মানুষ লালন পালন করার মতো অবস্থা তাদের ছিল না। সেই সময় খালু আম্মার জন্য এক বিয়ের প্রস্তাব আনলেন। লোকটি খালুর সাথেই চাকুরি করেন। এর আগেও দুই বার বিয়ে করেছেন। কিন্তু বাচ্চা হয়নি। পরে পরীক্ষা করে জানা গেছে উনি কখন‌ও বাবা হতে পারবেন না।উনি বাচ্চা খুব পছন্দ করেন। তাছাড়া কাজের মানুষের হাতে খাবার খাওয়ার জন্য উনি প্রায়‌ই অসুস্থ থাকেন। খালুর কাছে সব শুনে উনি নিজেই আম্মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। একদিন খালু লোকটিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন।

 

আম্মা আমাদের সামনেই লোকটিকে বলেন, “দেখেছেন তো আমার তিন ছেলে মেয়ে। আপনি কি ওদের সব দায়িত্ব নিতে পারবেন? ‌ওদের কখনো অবহেলা কষ্ট দিতে পারবেন না।আশা করি আপনি ভেবে চিন্তে এগোবেন।” কিছুক্ষন লোকটি আমাদের তিন ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার আপত্তি না থাকলে শুধু ওদের বাবা হয়েই আপনার সাথে থাকতে চাই। আম্মার বিয়ে নিয়ে পুরো গ্রামে হাসাহাসি শুরু হলো। আমরা লজ্জায় ঘর থেকে বের হ‌ই না। কিন্তু আম্মাকে দেখি এসব কথা শুনেও একেবারে নির্বিকার। যে আম্মার গায়ে একটা মাছি বসলেও সারা গ্রামের মানুষ শুনত, সেই আম্মা আজ যেন এক খন্ড পাথর। কোন কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না। পেছনের সব কিছু নির্বাসন দিয়ে শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন।আমরা যেন উনাকে বাবা বলে ডাকি খুব অনুনয় করে বললেন। আরো বললেন,”তোমাদের আব্বার সাথে আমাকে কখনো তুলনা করো না। তাহলে কষ্ট পাবে। প্রতিটি মানুষ‌ই তার নিজের মতো।” আমরা নতুন বাবার সাথে উনার দুই কামরার সরকারী বাসায় উঠলাম। আপু সিক্সে,আমি ফাইভে আর আরাফাত ফোরে। নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুল, বন্ধু বান্ধব সব সব নতুন। আমরা নতুন করে আবার শুরু থেকে সব শুরু করলাম। বাবা একটা ব্যপার খেয়াল করলেন আম্মা আমাকে দেখলেই রাগি চোখে তাকিয়ে থাকেন।

 

মনে হয় যেন আমি কোন অপরাধ করেছি। আমি আগেই খেয়াল করেছি আম্মার এই ব্যাপারটা কিন্তু আমি কাউকে বলিনি। আমি যতটুকু পারি আম্মার চোখের আড়ালে থাকি। একদিন বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এর কারন কি? উনি সব শুনে আমাকে উনার বুকের ভিতর নিয়ে নিলেন যেন কোন কষ্ট আমাকে ছুঁতে না পারে। বাবা আমাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। আমাদের এত সুন্দর করে বুঝিয়ে পড়াতেন যে আমাদের অন্য কোন স্যারের কাছে পড়ার প্রয়োজন‌ই হতো না।আম্মা শুধু দেখতেন কিছু বলতেন না। আব্বার মৃত্যুর পর কোন সেই জাদুবলে আম্মা সেই যে চুপ হলেন আর মুখ খুললেন না। নতুন বাবার বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজন আসতেন। আম্মা যথাসাধ্য উনাদের সেবা যত্ন করতেন। কেউই আম্মার খুঁত ধরতে পারতেন না। তাছাড়া আমার নানা বাড়ির, দাদা বাড়ির আত্মীয় স্বজন‌ও আমাদের দেখতে আসতেন। আম্মা তাদেরকেও যথাসাধ্য করার চেষ্টা করতেন। সবাই আম্মার এই পরিবর্তনে অবাক হতেন। সময় চলে যায়। এক সময় আমাদের পড়ার খরচ বাড়ে। আর এ খরচ সামাল দিতে বাবা অফিসের পর টিউশনি শুরু করেন।বাবাকে বলেছিলাম আমি কয়েকটা বাচ্চা পড়াই। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। আমার নাকি পড়ার ক্ষতি হবে।

 

পাপিয়া আপু এইচএসসি পাশ করে স্থানীয় কলেজে বিএ ভর্তি হয়। পরের বছর আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর বাবা আমাকে ঢাকায় পাঠায় কোচিং করার জন্য। আমি যেদিন ইন্জিনিয়ারিংএ চান্স পেলাম বাবা শিশুর মতো কান্না শুরু করলেন। পুরো কলোনির যারেই সামনে পাচ্ছেন বাবা তাকেই এনে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আম্মা যেন পাথর, কোন আনন্দই আম্মাকে স্পর্শ করে না। ভয়ে আমি আম্মার সামনেই যাই না। আম্মাকে আমরা সবাই অনেক ভালবাসি। তাকে আমরা হারাতে চাই না। আমি ঢাকা চলে আসলাম। পরের বছর আরাফাত মেডিকেলে চান্স পেল। বাবা চাকুরি থেকে অবসরে গেলেন। পেনশনের টাকায় বাবা পৈত্রিক জায়গায় ছোট একটা বাড়ি তৈরি করলেন। আপুকে বিয়ে দিলেন। আমি আর আরাফাত টিউশনি করে নিজেদের পড়ার খরচ চালাই। বাবার এই জন্য খুব মন খারাপ থাকে।আমরা এ নিয়ে বাবার সাথে খুনসুটি করি। আমি আর আরাফাত বাড়ি যাওয়ার সময় বাবার পছন্দের খাবার নিয়ে যাই।বাবা খুব খুশি হয়। আমি পাশ করার পর থেকেই বিদেশে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করি।

 

কয়েক মাসের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতে স্কালারশিপ পেয়ে যাই। যেদিন আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাব, সেদিন সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে আসে। আম্মা যে আসবে এটা আমি চিন্তাও করিনি। এত বছরে আম্মা এক দিনের জন্য‌ও কোথাও যায় নি। আমরা মাঝে মাঝে আব্বার কবর জিয়ারত করার জন্য যাওয়ার সময় আম্মাকে বলতাম আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু আম্মা কখন‌ই যেতেন না। আমি এখন‌ই ভেতরে ঢুকে যাব। আম্মাকে সালাম করে করে বললাম, আম্মা যাচ্ছি। মন খারাপ করো না।আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। আমার চেহারার সাথে আব্বার চেহারার অনেক মিল। আম্মা আমার দিকে তাকালেই আব্বার কথা মনে পড়ে যেত। আর তখন‌ই আম্মার আব্বার উপর অভিমান হতো। কারন আব্বা আম্মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।আব্বার এই অকালে চলে যাওয়াটা আম্মা সহ্য করতে পারেননি। তাই আমার উপর এত রাগ দেখাতেন।আম্মা আমার হাত ধরে বললেন,” বাবারে তোরে অনেক অবহেলা করেছি। তুই কিছু মনে রাখিস না।”আমি এত বছর পর আম্মার বুকে মাথা রেখে বললাম, বাবার দিকে খেয়াল রেখো।যে লোকটি নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে আমাদের সুখ দেখেছে তাকে অবহেলা কর না। ভালো থেকো।বাবাকে সালাম করার জন্য নিচু হতেই বাবা আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।বাবা কাঁদছেন আর বলছেন,এতো দিন তোকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছি। এখন আমি কিভাবে থাকবো বাবা। আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি। কিছুতেই আমার চোখের জল বাবাকে দেখাবো না। এমন মহৎ একজন মানুষকে বাবা হিসেবে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের তিন ভাই বোনের মতো ভাগ্যবান মানুষ পৃথিবীতে ক’জন আছে?

 

লেখক
আফরোজা (মুন্নি)
ঢাকা, বাংলাদেশ

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তারেক মনোয়ার একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী

» কুয়েতে নতুন আইনে অবৈধ প্রবাসীদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে

» সোশ্যাল প্লাটফর্মে লন্ডনী মেয়েদের বেলেল্লাপনা,চাম্পাবাত সবার শীর্ষে

» ফারুকীর পদত্যাগের বিষয়টি সঠিক নয়

» পাকিস্তান থেকে সেই আলোচিত জাহাজে যা যা এল

» মিছিল করায় আট মাস ধরে সৌদি কারাগারে ৯৩ প্রবাসী, দুশ্চিন্তায় পরিবার

» কুয়েতে যুবলীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

» ক্ষমা না চাইলে নুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়

» বাকু থেকে ফিরলেন ড. মুহাম্মাদ ইউনূস

» শুক্রবার আহত ও শহীদদের স্মরণে কর্মসূচি দিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

জীবন নদীর বাকেঁ ”গল্প”

আমি সোহেল। আমার বড় এক বোন পাপিয়া।আর ছোট এক ভাই আরাফাত। আমাদের গোছালো সংসার। মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনটি সন্তান নিয়ে যেমন থাকা যায় তেমন আমাদের পরিবার। অর্থের সচ্ছলতা না থাকলেও কোন দিন অভাবকে প্রশ্রয় দেয়নি আমার আব্বা। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের চাওয়াকে পূরণের চেষ্টা করেছেন আব্বা। ও বলা হয়নি আমার আব্বা কাপড়ের ব্যবসা করেন। আব্বা বাবুরহাট থেকে কাপড় নিয়ে সিলেট আর চট্টগ্রামে পাইকারী দামে বিক্রি করেন। তাতেই আমাদের লেখাপড়া সহ সংসার সুন্দর ভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের একটাই সমস্যা। আমার আম্মা কারো সাথেই ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। ভালো কথা থেকেও আম্মা ঝগড়া শুরু করেন। যার জন্য দাদা,দাদি, চাচা, ফুফু, পাড়াপ্রতিবেশী আমাদের এড়িয়ে চলেন। এমন কি আম্মার এই স্বভাবের জন্য নানা বাড়ির মানুষ জন‌ও আম্মাকে ভয় পায়।আমরা ভাই বোনেরা আম্মাকে ভীষন ভয় পাই।

 

পড়াশুনা ঠিক মতো না করলে বা পরীক্ষায় কোন কারনে খারাপ করলে আমাদেরকে তো মারতেন‌ই যে স্যার আমাদের তিন ভাই বোনকে বাসায় পড়াতেন তার উপর দিয়েও ঝড় ব‌য়ে দিতেন। একমাত্র আব্বা আম্মার সাথে কিভাবে যেন মানিয়ে চলেন। আব্বার শান্ত স্বভাবের কারনেই কিনা আম্মার সাথে কখনোই কথা কাটাকাটি হতে পর্যন্ত দেখিনি। আব্বা প্রতিবার সিলেট বা চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে আমাদের থেকেও বেশী আম্মার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যান, কারো সাথে যেন ঝগড়া বিবাদ না করে, ভালো ভাবে যেন সবার সাথে মিলে মিশে চলেন। কিন্তু আব্বা বলে যাওয়া পর্যন্তই।একদিক দিয়ে আব্বা বের হয়ে যান আরেকদিকে আম্মা তার স্বরূপে ফিরে যান। একদিন কাক ডাকা ভোরে খবর আসলো আব্বা যে বাসে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি আসছিলেন সেটা কুমিল্লার কাছে এক্সিডেন্ট করেছে। এ খবর শুনেই বাড়ি থেকে দুই কাকু র‌‌ওনা হয়ে গেলেন।

 

সন্ধ্যায় দুই কাকু আব্বার লাশ নিয়ে আসলেন। বাড়ির মধ্যে কান্নার রোল উঠলো। কিন্তু আম্মা সেই যে চুপ হলেন আর মুখ খুললেন না। আব্বা তেমন কিছুই আমাদের জন্য রেখে যেতে পারেন নি। অল্প কয়েক মাস কোন রকমে চলছে। আমাদের লেখাপড়া দূরে থাক খাবার জোগাড় করাই কষ্ট হয়ে পড়ছে।দাদা বাড়ির কেউই আম্মার স্বভাবের কারনে আম্মাকে দেখতে পারত না। নানা বাড়িতেও যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। এত গুলো মানুষ লালন পালন করার মতো অবস্থা তাদের ছিল না। সেই সময় খালু আম্মার জন্য এক বিয়ের প্রস্তাব আনলেন। লোকটি খালুর সাথেই চাকুরি করেন। এর আগেও দুই বার বিয়ে করেছেন। কিন্তু বাচ্চা হয়নি। পরে পরীক্ষা করে জানা গেছে উনি কখন‌ও বাবা হতে পারবেন না।উনি বাচ্চা খুব পছন্দ করেন। তাছাড়া কাজের মানুষের হাতে খাবার খাওয়ার জন্য উনি প্রায়‌ই অসুস্থ থাকেন। খালুর কাছে সব শুনে উনি নিজেই আম্মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। একদিন খালু লোকটিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন।

 

আম্মা আমাদের সামনেই লোকটিকে বলেন, “দেখেছেন তো আমার তিন ছেলে মেয়ে। আপনি কি ওদের সব দায়িত্ব নিতে পারবেন? ‌ওদের কখনো অবহেলা কষ্ট দিতে পারবেন না।আশা করি আপনি ভেবে চিন্তে এগোবেন।” কিছুক্ষন লোকটি আমাদের তিন ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার আপত্তি না থাকলে শুধু ওদের বাবা হয়েই আপনার সাথে থাকতে চাই। আম্মার বিয়ে নিয়ে পুরো গ্রামে হাসাহাসি শুরু হলো। আমরা লজ্জায় ঘর থেকে বের হ‌ই না। কিন্তু আম্মাকে দেখি এসব কথা শুনেও একেবারে নির্বিকার। যে আম্মার গায়ে একটা মাছি বসলেও সারা গ্রামের মানুষ শুনত, সেই আম্মা আজ যেন এক খন্ড পাথর। কোন কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না। পেছনের সব কিছু নির্বাসন দিয়ে শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন।আমরা যেন উনাকে বাবা বলে ডাকি খুব অনুনয় করে বললেন। আরো বললেন,”তোমাদের আব্বার সাথে আমাকে কখনো তুলনা করো না। তাহলে কষ্ট পাবে। প্রতিটি মানুষ‌ই তার নিজের মতো।” আমরা নতুন বাবার সাথে উনার দুই কামরার সরকারী বাসায় উঠলাম। আপু সিক্সে,আমি ফাইভে আর আরাফাত ফোরে। নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুল, বন্ধু বান্ধব সব সব নতুন। আমরা নতুন করে আবার শুরু থেকে সব শুরু করলাম। বাবা একটা ব্যপার খেয়াল করলেন আম্মা আমাকে দেখলেই রাগি চোখে তাকিয়ে থাকেন।

 

মনে হয় যেন আমি কোন অপরাধ করেছি। আমি আগেই খেয়াল করেছি আম্মার এই ব্যাপারটা কিন্তু আমি কাউকে বলিনি। আমি যতটুকু পারি আম্মার চোখের আড়ালে থাকি। একদিন বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এর কারন কি? উনি সব শুনে আমাকে উনার বুকের ভিতর নিয়ে নিলেন যেন কোন কষ্ট আমাকে ছুঁতে না পারে। বাবা আমাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। আমাদের এত সুন্দর করে বুঝিয়ে পড়াতেন যে আমাদের অন্য কোন স্যারের কাছে পড়ার প্রয়োজন‌ই হতো না।আম্মা শুধু দেখতেন কিছু বলতেন না। আব্বার মৃত্যুর পর কোন সেই জাদুবলে আম্মা সেই যে চুপ হলেন আর মুখ খুললেন না। নতুন বাবার বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজন আসতেন। আম্মা যথাসাধ্য উনাদের সেবা যত্ন করতেন। কেউই আম্মার খুঁত ধরতে পারতেন না। তাছাড়া আমার নানা বাড়ির, দাদা বাড়ির আত্মীয় স্বজন‌ও আমাদের দেখতে আসতেন। আম্মা তাদেরকেও যথাসাধ্য করার চেষ্টা করতেন। সবাই আম্মার এই পরিবর্তনে অবাক হতেন। সময় চলে যায়। এক সময় আমাদের পড়ার খরচ বাড়ে। আর এ খরচ সামাল দিতে বাবা অফিসের পর টিউশনি শুরু করেন।বাবাকে বলেছিলাম আমি কয়েকটা বাচ্চা পড়াই। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। আমার নাকি পড়ার ক্ষতি হবে।

 

পাপিয়া আপু এইচএসসি পাশ করে স্থানীয় কলেজে বিএ ভর্তি হয়। পরের বছর আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর বাবা আমাকে ঢাকায় পাঠায় কোচিং করার জন্য। আমি যেদিন ইন্জিনিয়ারিংএ চান্স পেলাম বাবা শিশুর মতো কান্না শুরু করলেন। পুরো কলোনির যারেই সামনে পাচ্ছেন বাবা তাকেই এনে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আম্মা যেন পাথর, কোন আনন্দই আম্মাকে স্পর্শ করে না। ভয়ে আমি আম্মার সামনেই যাই না। আম্মাকে আমরা সবাই অনেক ভালবাসি। তাকে আমরা হারাতে চাই না। আমি ঢাকা চলে আসলাম। পরের বছর আরাফাত মেডিকেলে চান্স পেল। বাবা চাকুরি থেকে অবসরে গেলেন। পেনশনের টাকায় বাবা পৈত্রিক জায়গায় ছোট একটা বাড়ি তৈরি করলেন। আপুকে বিয়ে দিলেন। আমি আর আরাফাত টিউশনি করে নিজেদের পড়ার খরচ চালাই। বাবার এই জন্য খুব মন খারাপ থাকে।আমরা এ নিয়ে বাবার সাথে খুনসুটি করি। আমি আর আরাফাত বাড়ি যাওয়ার সময় বাবার পছন্দের খাবার নিয়ে যাই।বাবা খুব খুশি হয়। আমি পাশ করার পর থেকেই বিদেশে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করি।

 

কয়েক মাসের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতে স্কালারশিপ পেয়ে যাই। যেদিন আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাব, সেদিন সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে আসে। আম্মা যে আসবে এটা আমি চিন্তাও করিনি। এত বছরে আম্মা এক দিনের জন্য‌ও কোথাও যায় নি। আমরা মাঝে মাঝে আব্বার কবর জিয়ারত করার জন্য যাওয়ার সময় আম্মাকে বলতাম আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু আম্মা কখন‌ই যেতেন না। আমি এখন‌ই ভেতরে ঢুকে যাব। আম্মাকে সালাম করে করে বললাম, আম্মা যাচ্ছি। মন খারাপ করো না।আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। আমার চেহারার সাথে আব্বার চেহারার অনেক মিল। আম্মা আমার দিকে তাকালেই আব্বার কথা মনে পড়ে যেত। আর তখন‌ই আম্মার আব্বার উপর অভিমান হতো। কারন আব্বা আম্মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।আব্বার এই অকালে চলে যাওয়াটা আম্মা সহ্য করতে পারেননি। তাই আমার উপর এত রাগ দেখাতেন।আম্মা আমার হাত ধরে বললেন,” বাবারে তোরে অনেক অবহেলা করেছি। তুই কিছু মনে রাখিস না।”আমি এত বছর পর আম্মার বুকে মাথা রেখে বললাম, বাবার দিকে খেয়াল রেখো।যে লোকটি নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে আমাদের সুখ দেখেছে তাকে অবহেলা কর না। ভালো থেকো।বাবাকে সালাম করার জন্য নিচু হতেই বাবা আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।বাবা কাঁদছেন আর বলছেন,এতো দিন তোকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছি। এখন আমি কিভাবে থাকবো বাবা। আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি। কিছুতেই আমার চোখের জল বাবাকে দেখাবো না। এমন মহৎ একজন মানুষকে বাবা হিসেবে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের তিন ভাই বোনের মতো ভাগ্যবান মানুষ পৃথিবীতে ক’জন আছে?

 

লেখক
আফরোজা (মুন্নি)
ঢাকা, বাংলাদেশ

 

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Thu, 21 Nov.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।