উপসম্পাদকীয়: রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আবারও আমাদের মাঝে হাজির হল মাহে রমজান। এ মাস এমন একটি মহিমান্বিত মাস, যে মাসের ১৭ই রমযান বদর প্রান্তরে বাতিলের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম সামরিক যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং বিজয় অর্জিত হয়। লাইলাতুল ক্বদরের মতো বরকতময় রজনীসহ অসংখ্য ফযীলত এ মাসে অন্তর্ভূক্ত।
এ মাসেই মানব জাতির জন্যে চূড়ান্ত হেদায়াত গ্রন্থ ও গাইড লাইন ‘আল কুরআন’ নাযিল হয়েছে তাই এ মাসকে কুরআনের মাস বলা হয়। আল্লাহর সমস্ত আসমানী গ্রন্থগুলো এ মাসে নাযিল হয়েছে বলে হাদিস শরীফের সমর্থন রয়েছে।
‘রজব’ শব্দের আবিধানিক অর্থ দগ্ধ করা, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া। শরীয়তের দৃষ্টিতে এ মাসে মানুষের গুনাহ গুলো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং মুমিনরা পাপ মুক্ত নিখুঁত ব্যাক্তিরুপে গড়ে উঠে।
একজন মানুষের মাঝে ২ টি সত্ত্বা বিরাজমান:
১) নৈতিক সত্ত্বা
২) জৈবিক সত্ত্বা
জৈবিক সত্তার উপর নৈতিক সত্ত্বা বা রুহ বিজয়ী হলে মানুষ হয় চরিত্রবান, পাপাচার করা বা অশ্লীল কাজ তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, নৈতিক সত্ত্বা বা রুহের উপর নফস বা জৈবিক সত্তার বিজয় হলে সে মানুষ কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে যায়। সততা ও নৈতিকতা তার থেকে বিদায় নেয়। আর মানুষের এই রুহ বা আত্মাকে শক্তিশালী করে তাকে তাকওয়াবান বা সৎচরিত্র বান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই রমজানের রোজাকে মানব জাতির জন্যে ফরজ করা হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ” তোমাদের জন্যে রমযানের রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। যেমনিভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তিদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (আল বাকারাঃ ১৮৩)
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ করেন- যে লোক রমযান মাসে রোযা রাখবে ঈমান ও ইহতেছাবের সাথে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।“ (বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযী)
যে সময়ে অন্ধকারের অমানিশা সমগ্র মানবতাকে ঢেকে নিয়েছি। যখন মানব সমাজের চারদিকে অসভ্যতা, নগ্নতা আর বর্বরতার বীভৎস তাণ্ডব চলছিল, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র মানব-মানবীরা কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিল। হত্যা, শরাব, ব্যাভিচার যখন প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত হচ্ছিল। জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়নের আহাজারি আল্লাহর আরশকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। মা, বোন, কন্যা পরিচয় হারিয়ে যখন তাদেরকে জীবন্ত পুতে ফেলার মাধ্যমে পাশবিকতার চরম অবস্থা বিরাজ করেছিল। মানবতার এক কঠিন দুর্দিনে লক্ষ কোটি জ্যোতিষ্কের আলোকবর্তিকা হাতে কুফরির জমাট বাঁধা অন্ধকারকে পায়ে ঠেলে এই রমযান মাসেই অবতীর্ন হয়েছিল মহা গ্রন্থ আল-কোরআন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “মাহে রমজান, যে মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে আল কোরআন, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও হেদায়েতের জন্য।” (বাকারা : ১৮৫)।
রমজান ও তাকওয়া:
মাহে রমজান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়।ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাবান কোনো কাজ নেই। দ্বীনের প্রাণশক্তিই হলো এ তাকওয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।’ (আল-হুজরাত: ১৩)
আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি।
ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তাআলার ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানব জীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন তাকে বলা হয় মুত্তাকী। রাসূলে কারিম (সা.) মদিনায় হিজরতের পর বনু সালেম ইবনে আমর ইবনে আওফ (রা.)-এর গোত্রে সর্বপ্রথম জুমুয়ার নামাজ আদায় করেন। জীবনের প্রথম জুমুআর খুৎবায় তিনি বলেন ‘আমি তোমাদেরকে তাকওয়া অর্জনের জন্য বিশেষভাবে উপদেশ দিচ্ছি’ ।
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-কে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমাকে কিছু ওসিয়ত করুন। তিনি বললেন- আমি তোমাকে তাকওয়ার ওসিয়ত করছি।’ (মুসনাদে আহমাদ)। ইসলামের পঞ্চম খলিফা খ্যাত হজরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (র.) জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে তাকওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি’। উম্মতের প্রতি নবীজির (সা.) অসিয়ত তাকওয়ার, খোলাফায়ে রাশেদিনের ওসিয়ত তাকওয়ার সর্বোপরী তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ১ মাস রোজা রাখা অত্যাবশ্যক করে দিলেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে রোজা কীভাবে মানুষকে মুত্তাকি বানায়? এর উত্তরে বলা যায়, অন্যসব ইবাদত যেমন নামাজ কিংবা দান, খয়রাত, সাদকা ইত্যাদিতে ‘রিয়া’ তথা লোক দেখানোর অবকাশ থাকে; কিন্তু মাহে রমজানের রোজার মধ্যে এসবের কোনো স্থান নেই। কেননা রোজাদার ব্যক্তি রোজা আছে কিনা তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সিয়াম পালনকারীর সামনে সুস্ব্বাদু ও লোভনীয় খাবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্বশীলতার কারণে সে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ক্ষুধা-পিপাসা ও খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছাকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই রোজাকে বলা হয় তাকওয়া অর্জনের মাস।
তাকওয়ার পুরষ্কারঃ
১. তাকওয়ার ফলে আল্লাহ আমাদের কাজকে সহজ করে দিবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন: যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন। [সূরা তালাক: ৪]
তিনি আরো বলেন: সুতরাং যে দান করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, আর উত্তমকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে, আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সুগম করে দেব।” [সূরা লাইল: ৫-৭]
২. তাকওয়ার ফলে আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের সব অনিষ্টতা হতে রক্ষা করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়।” [সূরা আরাফ: ২০১]
৩. তাকওয়ার ফলে আল্লাহ দুনিয়াবাসির জন্যে আসমান ও যমিনের বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমিন থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম। [সূরা আরাফ: ৯৬]
৪. তাকওয়ার ফলে আল্লাহ আমাদেরকে ন্যায়- অন্যায়, হক- বাতিলের ও সত্য- মিথ্যার পার্থক্য করে চলার গুন দান করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ওহে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি প্রদান করবেন, তোমাদের দোষ-ত্রুটি দূর করে দিবেন, তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন, আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। [সূরা আনফালঃ ২৯]
তিনি আরো বলেন: “হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তাহলে তিনি তোমাদের জন্য ফুরকান প্রদান করবেন।” [সূরা ফুরকান: ২৯]
৫. তাকওয়ার ফলে আল্লাহ আমাদের জন্য উত্তম রিযিকের ব্যবস্থা করে দিবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন: আর তাকে রিযেক দিবেন (এমন উৎস) থেকে যা সে ধারণাও করতে পারে না। যে কেউ আল্লাহর উপর ভরসা করে, তবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। [সূরা তালাকঃ ৩]
৬. তাকওয়ার দ্বারা পার্থিব জগতে বান্দা আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। কারণ তিনি মুত্তাকীদের বন্ধু ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আর নিশ্চয় যালিমরা মূলত একে অপরের বন্ধু এবং আল্লাহ মুত্তাকীদের বন্ধু।” [সূরা জাসিয়া: ১৯]
৭. তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য আখেরাতে জান্নাতে সুদৃঢ় প্রাসাদ থাকবে, যার উপরেও থাকবে প্রাসাদ।
আল্লাহ তাআলা বলেন: কিন্তু যারা নিজেদের রবকে ভয় করে তাদের জন্য রয়েছে কক্ষসমূহ যার উপর নির্মিত আছে আরো কক্ষ। তার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত। এটি আল্লাহর ওয়াদা; আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না।”
[সূরা যুমার: ২০]
৮. আখেরাতে তাকওয়া গুনাহের কাফফারা হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন এবং তার প্রতিদানকে মহান করে দেন।” [সূরা তালাক: ৫]
রাসূলে পাক (সঃ) ইরশাদ করেন, হযরত সাহল ইবনে সা’য়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, বেহেশতে একটি দরজা আছে, উহাকে – রাইয়ান বলা হয়। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র রোযাদারগণই বেহেশতে প্রবেশ করবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেনা, সেদিন এ বলে ডাকা হবে, রোযাদারগণ কোথায়? তারা যেন এ পথ দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। এভাবে সকল রোযাদরগণ ভিতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে। অত:পর এপথে আর কেউ প্রবেশ করবেনা। (বোখারী ও মুসলিম)
পবিত্র রমজান মাসে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখিত কতিপয় আমল দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি :
ক) আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের উদ্দেশ্যে সিয়ামঃ
আমাদের ইবাদতের অনেক গুলো উপলক্ষ থাকলেও কালের বিবেচনায় এসব উপলক্ষের মধ্যে সর্ব উৎকৃষ্ট , সম্মানের বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ হল মাহে রমজান।
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, যখন রমযান মাস আসে রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
খ) নিয়মিত তারাবীহের নামাজ আদায় করাঃ
আল্লাহের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তারাবীহ পরতে হবে। কেননা, যে ব্যক্তি রমজানে তারাবীহ নামাজ পড়বে তার অতীতের সগিরা গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত , আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) রমজান মাসের নামাজ কায়েম করার জন্য উৎসাহ দান করতেন। এইরূপ বলতেন, যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের নামাজ কায়েম করবে তার পূর্ব বর্তী (সগিরা) গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।(মুসলিম)
গ) কিয়ামুল লাইলঃ
কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। মহানবী (সাঃ) কিয়ামুল লাইল কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং সাহাবায়ে কেরামগন কেও উৎসাহ করতেন। রাসুল(সাঃ) বলেন, রমজানে মাসে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘ইমাম সাহেব সালাত শেষ করা পর্যন্ত (তারাবীহ) তার সাথে যে সালাত আদায় করবে সে পূর্ণ এক রাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে’।(আবু দাউদ)
এ ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে যে অমনোযোগিতা দেখা যায় তা হল রমাজানের প্রথম রাতে তারা অংশ নিতে পারে না। আবার অনেকে রমজানের শেষ দিকে অলসতায় পেয়ে বসে। ফলে তারা পূর্ণ রমজানের কিয়ামুল লাইলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়।
ঘ) সদকা বা দানঃ প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রসূল(সাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সব চেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার আরো বেড়ে যেত।(মুসলিম)
ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন, রাসুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল রমজান মাসে বেশি বেশি দান-সদকা করা।
ঙ) ইতিকাফঃ ইতিকাফে বসার অর্থ হচ্ছে, রমজান মাসের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা এবং এ দিনগুলোকে আল্লাহ্র যিকিরের জন্য নির্দিষ্ট করা।
ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সাঃ) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন।(মুসলিম) ইতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, আশ্চার্য জনক হল মুসলমানেরা ইতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসুল (সাঃ) মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো ইতেকাফ পরিত্যাগ করেনি।
চ) রোজাদারদের ইফতার করানোঃ
ইবনে খালেদ আল-জুহানি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সম পরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।” [ তিরমিযি]
আবু সাওয়ার আল-আদাওয়ি বলেন, বনি আদি গোত্রের লোকেরা এই মসজিদে নামায পড়ত। তাদের কেউ কখনো একাকী ইফতার করেনি। যদি তার সাথে ইফতার করার জন্য কাউকে সাথে পেত তাহলে তাকে নিয়ে ইফতার করত। আর যদি কাউকে না পেত তাহলে নিজের খাবার মসজিদে নিয়ে এসে মানুষের সাথে খেত এবং মানুষকেও খেতে দিত।
খাবার খাওয়ানোর ইবাদতের মাধ্যমে আরও অনেকগুলো ইবাদত পালিত হয়:
নিমন্ত্রিত ভাইদের সাথে হৃদ্যতা ও ভালবাসা। যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা জান্নাতে প্রবেশের কারণ। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা ঈমান আনা ছাড়া জান্নাত যেতে পারবে না। আর পারস্পারিক ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের ঈমান হবে না।”[সহিহ মুসলিম (৫৪)]
দাওয়াত খাওয়ানোর মাধ্যমে নেক লোকদের সাহচর্য অর্জিত হয় এবং আপনার খাবার খেয়ে তারা নেককাজের শক্তি পায়, এতে আপনার সওয়াব হয়।
ছ) কুরআন খতম ও তেলাওয়াতঃ
কোরআনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোরআন হলো মানুষের জন্য হেদায়াত এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। কোরআনই মানব জাতিকে শিরকের অন্ধকার হতে তাওহিদের আলোয় আলোকিত করে।
শ্রেষ্ঠ মাসে শ্রেষ্ঠ রাতে শ্রেষ্ঠ নবীর উপর অবতীর্ণ হয়েছে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন। কোরআনে রমজান মাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মাহে রমজান, যে মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে আল কোরআন, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও হেদায়েতের জন্য।’(বাকারা : ১৮৫)।
এ আয়াতে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস রমজানুল মুবারক বলা হয়েছে। সে কারণেই এ মাসকে কোরআনের মাস বলা হয়।
রমজান মাসের প্রধান আমল হলো কোরআন তেলাওয়াত। পবিত্র কোরআনের তেলাওয়াত এবং তা শোনার জন্য রমজানের প্রতি রয়েছে ২০ রাকাত তারাবির বিধান। তারাবির মাধ্যমে পড়া ও শোনা হয় সুরা ফাতিহা থেকে সুরা নাস পর্যন্ত পুরো কোরআন। কোরআন তেলাওয়াতে প্রতিটি হরফে ১০টি করে নেকি পাওয়া যায়। কিন্তু রমজানের ফজিলতের কারণে তা ৭০ গুণে বৃদ্ধি হয়ে প্রতি হরফে পাওয়া যায় ৭০০ নেকি।
তাই বেশি বেশি কোরআনের তিলওয়াত, হিফজ, ও গভীর ধ্যানের মাধ্যমে কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা, আর গভীরভাবে চিন্তা করা। কেননা এই কোরআন মানব জাতির জন্য স্রষ্টার পক্ষ হতে মহা বিধান, সকল অন্ধকারের জন্য আলো। যাবতীয় পাপাচার বিকৃতি হতে মানব জাতিকে হিফাজতের মহা কারিকুলাম, হৃদয়ের প্রশান্তি, জ্ঞানীদের উজ্জ্বলতা, চরিত্র গঠনের দিনপঞ্জী, ইহ জগতে সুখ-শান্তির চাবি, পরকালের মুক্তির দিশারী ও চিরস্থায়ী সফলতার গ্যারান্টি। অনেকে মনে করে, না বুঝে কোরআন পড়লে কোনো নেকি পাওয়া যায় না। এ ধারণা একান্তই ভুল। না বুঝে পড়লেও উল্লেখিত নেকি পাওয়া যায়। এতে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই। শরিয়তে এটি একটি স্বীকৃত বিষয়।
পবিত্র এ মাসে একজন মুমিনের জন্য অন্যান্য নফল ইবাদতের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাধিক নেকির আমল হলো তেলাওয়াতে কোরআন। তবে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে, কোরআন তেলাওয়াতের এ নেকি পেতে হলে কোরআন সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়তে হবে। ভুল পড়লে নেকির পরিবর্তে গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
জ) মনীষীদের কোরআন তেলাওয়াত:
রমজান এলে পূর্বেকার মনীষীরা কোরআনময় হয়ে যেতেন! কোরআনের সাথে গড়ে তুলতেন গভীর সখ্য। কোরআনই হয়ে যেতো তাদের জীবনসঙ্গী, সফরসঙ্গী তথা নিত্যসঙ্গী। পবিত্র কোরআনের প্রতি তাদের ভালবাসা ছিল অমলিন ঈর্ষণীয় ও সীমাহীন।
ইমাম আবু হানিফা (র.) এর কথা প্রসিদ্ধ আছে, তিনি রমজান মাসে ৬১ খতম তিলাওয়াত করতেন।
ইমাম আবু বকর ইবনে আইয়্যাশ (র.) ত্রিশ বছর যাবৎ প্রতিদিন একবার কোরআন খতম করতেন। এ সম্পর্কে ইমাম নববী (র.) বলেন ‘হযরত ইব্রাহীম ইবনে আবু বকর আয়্যাশ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমাকে বললেন, নিশ্চয় তোমার পিতা কখনও ফাহিশা (গর্হিত, যিনা-ব্যভিচার) কাজ করেনি। আর সে ত্রিশ বছর যাবৎ প্রতিদিন এক খতম কোরআন তেলাওয়াত করেছে। ইমাম ইবনে কাসীর (র.) ইমাম বোখারী রহ. এর আমল সম্পর্কে লিখেছেন তিনি প্রত্যেক রাতে তেরো রাকাত নামায আদায় করতেন। আর রমজান মাসে প্রত্যেক রাতে এক খতম কোরআন তেলাওয়াত করতেন। রাসুল(সাঃ) এর রামজান মাসে একাধিক বার কুরআন খতম করা নিয়মিত আমল ছিল। নবী কারিম (সাঃ) বলেন, সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে।
একটি সমৃদ্ধশালী জাতী গঠনে সংযম প্রয়োজন। পবিত্র মাহে রমজান মাসের সিয়াম সাধনের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী তাকওয়া সম্পন্ন জাতি গঠন সম্ভব। আজকে এ মাসকে উপলক্ষ্য করে কুরআনের উপর খুববেশী ঘষা মাজা হলেও এ মাস শেষে এই পবিত্র কুরআনকে গিলাফবন্দী করে সযত্নে পেলে রাখা হয়। আমাদের বাস্তব জীবনে পেড়েনা এ কুরআনের মহান শিক্ষার কোন আলামত। যার কারনে রমযানের ১ম দিকে আমাদের মসজিদগুলোতে দাঁড়ানোর কোন ঠাই না থাকলেও পরবর্তী দিনগুলোতে তাতে ভাটা পড়তে শুরু করে।
সুতরাং রমজান মাসে সিয়াম সাধনাকে শুধুমাত্র অনুষ্ঠান সর্বস্ব একটি ধর্মীয় ইবাদাতে পরিণত না করে বরং আত্মশুদ্ধি ও প্রশিক্ষণের যে সুযোগ আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন, সেই টার্গেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। নফসের গোলামি থেকে বের হয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ আল্লাহর গোলাম এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ কারীদের কাতারে শামিল করতে, এই রোজা যেন আমাদেরকে ব্যর্থ এবং নিষ্ফল শুধুমাত্র উপবাসকারী হিসেবে পরিণত না করে।
তাই আসুন আমরা সংযমী হই, নিজেদের লোভ ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করি।
রাসুল(সাঃ) বলেছেন, ” যে ব্যাক্তি মিথ্যা কথা, সে অনুযায়ী কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খাদ্য ও পানীয়ো থেকে বিরত থাকায় আল্লাহ্র কন প্রয়োজন নাই”
কবির ভাষায়ঃ
রক্ষিত যদি না হয় কর্ণ
দৃষ্টিতে না থাকে বাঁধা,
তবে বুঝে নিও আমার রোজা কেবলই তৃষ্ণা ও পিপাসা
যদি বলি আমি আজ রোজা,
মনে করিও আমি আদৌ রোজাদার নই।
লেখকঃ কলামিষ্ট ও গবেষক
Social Media: www.facebook.com/rabiulislam.official