
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিটিআই নেতা ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই রায় দিয়ে বলেন, ‘অবিলম্বে’ ইমরানকে মুক্তি দিতে হবে।
তবে গত রাতের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে পুলিশ লাইনসের অতিথি ভবনে ‘কারামুক্ত’ হিসেবে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
চূড়ান্ত রায়ের আগে গতকাল দুপুরে প্রথম দফা শুনানির পর এক ঘণ্টার মধ্যে ইমরানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে একটি বিশেষ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। গতকালের রায়ের মধ্য দিয়ে এ নির্দেশের আর কোনো কার্যকারিতা থাকল না।
চূড়ান্ত রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, এমনকি এনএবির আদালত চত্বর থেকেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। আদালত জিজ্ঞাসা করেন, ৯০ জন রেঞ্জার্স সদস্য আদালত চত্বরে প্রবেশ করলে আদালতের মর্যাদা কিভাবে থাকে? কিভাবে একজন ব্যক্তিকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়?
আজ শুক্রবার ইমরান খানকে আদালতে আগের মামলায় হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘আপনাকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে।’
আদালতে ইমরান নিজের বাড়ি ফেরার আর্জি জানান। এ সময় আদালত তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, অতিথি ভবনে তিনি বেশ স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। আদালত আরো জানান, ইমরানের সঙ্গে অতিথি ভবনে ১০ জনকে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে। সেখানে অবস্থানের সময় সরকারকে তাঁর নিশ্চয়তার দায়িত্ব নিতে হবে।
ইমরান খানকে হাজির করার প্রক্রিয়া শুরুর পর গতকাল সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে পিটিআইয়ের তরফ থেকে কর্মী-সমর্থকদের আদালত প্রাঙ্গণে না আসার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালতে ইমরান অভিযোগ করেন, তাঁকে হাইকোর্ট চত্বর থেকে অপহরণ করা হয়েছে। রেঞ্জার্স বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে প্রহার করেছেন। তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা কোনো খুনির সঙ্গেও করা হয় না।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ : আদালতের কার্যক্রমের পর ইমরান সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপ করেন। এ সময় দেশে কী ঘটছে জানেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘না’ বলেন। তবে তিনি যাবতীয় সহিংসতার নিন্দা জানান এবং দেশের ক্ষতি না করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ইমরান বলেন, ‘আমরা শুধু চাই নির্বাচন।’ গ্রেপ্তারের পর তাঁর সঙ্গে এনএবি ছাড়া আর কেউ দেখা করেছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে হেসে ইমরান বলেন, ‘না’।
ইমরানের প্রশংসায় প্রধান বিচারপতি : আদালতে হাজির হওয়ার পর ইমরানের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বলেন, ‘আপনাকে দেখে প্রীত হলাম।’ রায় দেওয়ার আগে তিনি আরো বলেন, ২৩ কোটি মানুষ তাদের জাহাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য নেতার অপেক্ষায় রয়েছে। আপনি এই জাহাজ এগিয়ে নিতে তাদের সাহায্য করতে পারেন। আপনার বিরোধী পক্ষকে হয়তো সঠিক না-ও মনে হতে পারে। কিন্তু তারা বাস্তবতা।’
প্রধান বিচারপতি ইমরানকে আরো বলেন, ‘আপনার গ্রেপ্তারের পর দেশে সহিংসতা হয়েছে। আদালত শান্তি চান।’
পিটিআই শিবিরে উল্লাস : নেতার মুক্তির রায় আসার পর উল্লাসে ফেটে পড়ে পিটিআই কর্মী-সমর্থকরা। এ সময় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। পিটিআই নেতা উসমান দার আদালতের রায়কে ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ আখ্যা দেন। দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা শাহবাজ গিল রাজপথ না ছাড়ার আহ্বান জানান।
রায়ে নাখোশ সরকার : ইমরানকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তে নাখোশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ে ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) প্রধান মরিয়ম নওয়াজ। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি একজন অপরাধীকে (ইমরান) মুক্তি দিয়ে বেশ খুশি। মরিয়ম নওয়াজ প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করে পিটিআইতে যোগ দিতে বলেন।
সাবেক স্ত্রীর সন্তোষ : ইমরানের গ্রেপ্তারকে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করার পর তাঁর সাবেক স্ত্রী ব্রিটিশ চলচ্চিত্র প্রযোজক জেমিমা গোল্ডস্মিথ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাজ্যে ছেলের সঙ্গে বসবাসকারী জেমিমা টুইটারে লেখেন, ‘অবশেষে বিবেচনাবোধ ফিরে এসেছে।’
আইনজ্ঞদের মতামত : আইনজীবী আবদুল মইজ জাফেরি বলেছেন, এটা জরুরি ছিল। হাইকোর্ট যে যুক্তি দিয়ে গ্রেপ্তারকে বৈধ বলেছেন তা দুর্বল। তিনি বলেন, আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা উচিত। ইমরানেই বিষয়টা শুরু ও শেষ হলে তা রাজনৈতিক বলেই গণ্য হবে।
আইনজীবী মির্জা ময়েজ বেগ বলেন, ‘এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শীর্ষ আদালত আগেও আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তারকে অবৈধ বলেছেন।’ অন্যদিকে আইনজীবী উসামা খাওয়ার এ ঘটনাকে এনএবির অধ্যাদেশ তথা পুরো ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার এবং হাইকোর্টে জামিন আবেদন নাকচ হওয়া কাউকে দুই দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের মুক্তি দেওয়ার একটিও উদাহরণ নেই। রিদা হোসেন একে সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত বলেছেন। বাসিল নবি মালিক বলেন, ‘এটি ভারসাম্যমূলক উদ্যোগ। শীর্ষ আদালত ইমরানকে ছাড়লেও নিঃশর্ত মুক্তি দেননি।’
গণহারে গ্রেপ্তার পিটিআই নেতারা : গতকাল রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হন পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি। এরপর দলটির নেতা আলী মোহাম্মদ খান ও ইজাজ চৌধুরীকেও ইসলামাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত দুই দিনে বিভিন্ন প্রদেশে দলের শীর্ষ পর্যায়ের আরো কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গিলগিট বালতিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খালিদ খুরশিদকে ইসলামাবাদে গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ উঠেছে।
টানা সহিংসতায় পুলিশের গুলিসহ বিভিন্নভাবে গতকাল পর্যন্ত নিহত হয়েছে আটজন। গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজার ৬০০ জনের ওপরে। বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনায় নতুন করে সাতটি মামলা হয়েছে, যেখানে ইমরানসহ পিটিআইয়ের শীর্ষ নেতৃত্বকে আসামি করা হয়েছে।