Menu |||

চীনের কাছে শেভরনের গ্যাসক্ষেত্র বিক্রি এবং আমাদের ব্যর্থতার নেপথ্যে কী?

বাংলাদেশের মোট গ্যাস চাহিদার ৫৫ ভাগ আসে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে।  সিলেটের বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজার।  এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করে আমেরিকান জায়ান্ট তেল কোম্পানি শেভরন।  গতো এক মাস আগে থেকে শোনা যাচ্ছে শেভরন বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে এবং তার ব্যবসা বিক্রি করে দিচ্ছে চীনের হিমালয়া কোম্পানির কাছে।  হিমালয়া মূলত চায়না ঝেনহুয়া অয়েল ও সিএনআইসি (সিনিক) কর্পোরেশন এর একটি অংশ, যাদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের তেল কোম্পানিগুলোর চাইতে অনেক কম।

গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারেনি আদতে কী ঘটছে এবং লক্ষণীয় ছিলো যে আমাদের সরকার এবং পেট্রোবাংলার মুখে কোনো রা ছিলো না। এখনও তেমন নেই বললেই চলে। যতোই দিন যাচ্ছে এ বিষয়ে যে সকল তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

৩০ মে ডিবিসি নিউজ চ্যানেলে ‘টালিখাতা’ শিরোনামের একটি আলোচনা অনুষ্ঠান শুনে বিষয়টি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেলো এবং সেই সাথে পাওয়া গেলো কিছু দিক নির্দেশনা।  এজি মাহমুদের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাব এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। ডিবিসি প্রতিনিধি ইব্রাহিম পাঠানের একটি চমৎকার প্রতিবেদনও ছিলো সেই অনুষ্ঠানে।  আমি আগেভাগে এই চারজন ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং এ বিষয়ে ডিবিসির গবেষণা দলও নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এই আলোচনায় কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে সেগুলি মোটামুটি নিম্নরূপ।

১।  গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসান সামাল দিতে শেভরন বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
২।  পেট্রোবাংলা সিদ্ধান্তটি তখনই জানালো যখন হিসাব অনুযায়ী মোট মজুতের প্রায় আশিভাগ গ্যাস উত্তোলন হয়ে গেছে, মাত্র বিশ ভাগ যেটা তাদের ভাগে পড়ার কথা সেটা তারা বিক্রি করে দিচ্ছে।
৩।  চুক্তি অনুয়ায়ী শেভরন ব্যবসায় তাদের অংশ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে হলে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নেয়ার কথা, কিন্তু সেটা তারা করেনি।
৪।  শেভরন বাংলাদেশ সরকার এবং পেট্রোবাংলাকে অবহিত না করেই চীনের হিমালয়ার ৯ জন প্রতিনিধিকে দেশে এনেছে এবং স্থাপনা পরিদর্শন করিয়েছে যা ছিলো নিয়ম পরিপন্থী।
৫।  শেভরন পেট্রোবাংলা এবং সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে চীনের সাথে ২ বিলিয়ন ডলারে ওই গ্যাসক্ষেত্র বিক্রি করার জন্যে প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদন করেছে, যা বিচারের সম্মুখীন হওয়ার মতো অপরাধ।
৬।  কস্ট রিকভার করার পর তেলক্ষেত্রের সকল স্থাপনা, যন্ত্রপাতি, সফ্টওয়্যার প্রভৃতি আমাদের সম্পত্তি কিন্তু সেগুলো শেভরন আস্তে আস্তে অকেজো করে দিচ্ছে এবং চীনা কোম্পানীকে পুণরায় স্থাপনা বসানোর খরচ করিয়ে আরেক দফা কস্ট রিকোভারি দেখিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
৭।  উক্ত গ্যাস ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ কর্মী বর্তমানে কর্মরত।  তাদের চাকুরির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সেখানে শেভরনের প্রেসিডেন্ট তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করার হুমকী পর্যন্ত দিয়েছেন।
৮।  ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসার পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচী নৈরাশ্যব্যঞ্জক।  তারা একটি সার্ভে কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে।  ওই কোম্পানির জরিপের পরই তারা শেভরনের সঙ্গে গ্যাসক্ষেত্র তিনটি ক্রয়ের বিষয়ে কথা বলবেন বলছেন।  প্রশ্ন হচ্ছে এর আগেই যদি শেভরন চীনা কোম্পনিকে গ্যাস ক্ষেত্র বুঝিয়ে দিয়ে ফ্লাই করে চলে যায়, তখন বাংলাদেশ কী করবে?
৯।  শেভরন বাংলাদেশ সরকারকে কেয়ারই করছেনা, তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো কাজ করছে।
১০।  অতীতে ইউনিকল এবং নাইকো কর্তৃক বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়।  তারা আমাদের প্রচুর গ্যাস নষ্ট করেছে এবং নানাভাবে ঠকিয়েছে।
১১।  বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক দক্ষ জনবল তৈরী হয়েছে যারা নিজেরাই গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতে সক্ষম।
১২।  চীনের কাছে যে দামে বিক্রি করা হচ্ছে অর্থাৎ ২ বিলিয়ন ডলার, আদতে তার মূল্য অতো নয়, চীন মূলত জিও পলিটিক্সের অংশ হিসেবেই এখানে আসতে চাইছে।
১৩।  বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে শেভরনের এই অশুভ উদ্যোগ প্রতিহত করতে পারে এবং শেভরনের কাছে ন্যায্য দামে গ্যাসক্ষেত্র তিনটি কিনে নিতে পারে।

বাংলাদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নতুন নয়।  আমেরিকান কোম্পানিকে এদেশের তেল-গ্যাস ক্ষেত্র ইজারা দিতে রাজি না হওয়ায় শেখ হাসিনা সরকারকে একবার ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি বলে শোনা যায়।  সে কারণেই কি শেভরন এখানে খেয়াল খুশি মতো কাজ করছে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের অংশ চীনের কাছে বিক্রি করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে?  খনিজ তেল বাণিজ্য করে মধ্যপ্রাচ্যের গরীব দেশগুলো মাত্র কয়েক দশকে  বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও কোন ব্যর্থতার কারণে এই খাতে আমরা এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সফলতা দেখাতে পারিনি, ভেবে দেখা দরকার।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কী করে বিদেশি কোম্পানিগুলো এভাবে দাপট দেখাতে পারে, তা জাতিকে সত্যিই হতবাক করে দেয়।  শেভরণের আচরণে আমরা ইংরেজ শাসনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে পারি।  প্রথমে তারা এদেশে এসেছিলো মূলত ব্যবসা করার জন্যে। কিন্তু সেই ব্যবসায়ীরা কী করে কিছু মীরজাফরের মতো সুবিধাবাদী চক্রকে হাত করে মসনদ দখল করে দু’শো বছরের জন্যে উপমহাদেশকে শাষন, শোষন, লুটপাটের জায়গা বানিয়েছিলো আমরা ভুলিনি।  অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রকারন্তরে আমরা এখনো সেই বলয় থেকে মুক্ত হতে পারিনি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা এখনও আমাদের তেল-গ্যাস আমরা নিজেরা উঠাতে পারিনা, বিদেশি কোম্পানি লাগে, এটা সত্যিই বিস্ময়কর এবং লজ্জ্বাজনক।  এটা কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, নাকি রাজনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি অন্য কিছু জানা দরকার।
আমাদের বিপুল সংখ্যক দক্ষ কর্মী তৈরী হয়েছে যারা প্রযুক্তি সুবিধা পেলে নিজেরাই গ্যাসক্ষেত্রগুলো অপারেট করতে পারে।  শেভরনই কি প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ নয় যেখানে ৯৪ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশি?  আমাদের দেশিয় কোম্পানি তিতাস এর মতো কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতা চায়নার হিমালয়ার চাইতে বেশি।  সুতরাং কোন যুক্তিতে কিংবা কার ইশারায় সমস্ত নিয়মকানুন,  চুক্তির ধারাকে অগ্রাহ্য করে শেভরন এ ধরণের একটা কাজ করতে পারলো ভেবে দেখার সময় এসেছে।  শুধু তাই নয়, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে প্রযুক্তি আমদানীর মাধ্যমে দেশীয় প্রকৌশলী ও কর্মী দ্বারা  তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, আহরণ ও সরবরাহ কেন করা হয়না বা হচ্ছেনা, এর উত্তর কে দিবে? চীনের বদলে নিজেদের সম্পদ নিজেদেরই আয়ত্বে কেন রাখছি না, সেখানে কার বা কাদের স্বার্থ জড়িতে আছে সেটাও অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

আমাদের দেশে ‘তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি’ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। সম্প্রতি রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে তাদের আন্দোলন সংগ্রাম চোখে পড়ার মতো।  কিন্তু লক্ষণীয় যে- শেভরনের এই অপকর্মে  যখন দেশের স্বার্থ বিনষ্ট হচ্ছে, তখন তাদের কাউকে কিছু বলতে দেখছি না।  মিছিল-মিটিং দূরে থাক, একটা বিবৃতি পর্যন্ত নেই।  তবে কি আমরা ধরে নেবো যে- তাদের সব আন্দোলন সংগ্রামের টাকা আসে চীন থেকে, যে কারণে শেভরনের পক্ষ থেকে চীনা কোম্পানিকে  স্বাগত জানানোতে তাঁরা খুশি এবং ভারতীয় কোম্পানি কর্তৃক রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বলেই তাদের যতো গাত্রদাহ?

Facebook Comments Box

সাম্প্রতিক খবর:

বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

চুরি হওয়া টাকা'ই ঋণের জন্য ব্যবহার হয়

ক্রোধের স্রোত অত্যাচারীদের ধ্বংস করে- আহমেদ আল-জারাল্লাহ

কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ মকবুল হোসেনের সফলতার গল্প

কুয়েতে ঈদুল ফিতর উদযাপিত এবং রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়

কান্না দেখে কাঁদছে হৃদয়, আমি মোটেও হৃদয়হীন নয়

হাসনাতের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তোলপাড় সোশ্যাল প্লাটফর্ম

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কুয়েতে বিজয় দিবস কাপ-২০২৫ এর সেমিফাইনালে উঠেছে নবজাগরণ স্পোর্টিং ক্লাব

» কুয়েত ফেরত প্রবাসী মো. সাদ মিয়া আর নেই

» বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

» ফিলিস্তিনের পক্ষে লন্ডনের রাজপথে প্রবাসী বাংলাদেশিরা

» বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

» চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

» আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের

» কুয়েতে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত

» কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

» কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

চীনের কাছে শেভরনের গ্যাসক্ষেত্র বিক্রি এবং আমাদের ব্যর্থতার নেপথ্যে কী?

বাংলাদেশের মোট গ্যাস চাহিদার ৫৫ ভাগ আসে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে।  সিলেটের বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজার।  এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করে আমেরিকান জায়ান্ট তেল কোম্পানি শেভরন।  গতো এক মাস আগে থেকে শোনা যাচ্ছে শেভরন বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে এবং তার ব্যবসা বিক্রি করে দিচ্ছে চীনের হিমালয়া কোম্পানির কাছে।  হিমালয়া মূলত চায়না ঝেনহুয়া অয়েল ও সিএনআইসি (সিনিক) কর্পোরেশন এর একটি অংশ, যাদের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের তেল কোম্পানিগুলোর চাইতে অনেক কম।

গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারেনি আদতে কী ঘটছে এবং লক্ষণীয় ছিলো যে আমাদের সরকার এবং পেট্রোবাংলার মুখে কোনো রা ছিলো না। এখনও তেমন নেই বললেই চলে। যতোই দিন যাচ্ছে এ বিষয়ে যে সকল তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

৩০ মে ডিবিসি নিউজ চ্যানেলে ‘টালিখাতা’ শিরোনামের একটি আলোচনা অনুষ্ঠান শুনে বিষয়টি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেলো এবং সেই সাথে পাওয়া গেলো কিছু দিক নির্দেশনা।  এজি মাহমুদের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাব এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। ডিবিসি প্রতিনিধি ইব্রাহিম পাঠানের একটি চমৎকার প্রতিবেদনও ছিলো সেই অনুষ্ঠানে।  আমি আগেভাগে এই চারজন ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং এ বিষয়ে ডিবিসির গবেষণা দলও নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এই আলোচনায় কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে সেগুলি মোটামুটি নিম্নরূপ।

১।  গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসান সামাল দিতে শেভরন বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
২।  পেট্রোবাংলা সিদ্ধান্তটি তখনই জানালো যখন হিসাব অনুযায়ী মোট মজুতের প্রায় আশিভাগ গ্যাস উত্তোলন হয়ে গেছে, মাত্র বিশ ভাগ যেটা তাদের ভাগে পড়ার কথা সেটা তারা বিক্রি করে দিচ্ছে।
৩।  চুক্তি অনুয়ায়ী শেভরন ব্যবসায় তাদের অংশ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে হলে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নেয়ার কথা, কিন্তু সেটা তারা করেনি।
৪।  শেভরন বাংলাদেশ সরকার এবং পেট্রোবাংলাকে অবহিত না করেই চীনের হিমালয়ার ৯ জন প্রতিনিধিকে দেশে এনেছে এবং স্থাপনা পরিদর্শন করিয়েছে যা ছিলো নিয়ম পরিপন্থী।
৫।  শেভরন পেট্রোবাংলা এবং সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে চীনের সাথে ২ বিলিয়ন ডলারে ওই গ্যাসক্ষেত্র বিক্রি করার জন্যে প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদন করেছে, যা বিচারের সম্মুখীন হওয়ার মতো অপরাধ।
৬।  কস্ট রিকভার করার পর তেলক্ষেত্রের সকল স্থাপনা, যন্ত্রপাতি, সফ্টওয়্যার প্রভৃতি আমাদের সম্পত্তি কিন্তু সেগুলো শেভরন আস্তে আস্তে অকেজো করে দিচ্ছে এবং চীনা কোম্পানীকে পুণরায় স্থাপনা বসানোর খরচ করিয়ে আরেক দফা কস্ট রিকোভারি দেখিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
৭।  উক্ত গ্যাস ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ কর্মী বর্তমানে কর্মরত।  তাদের চাকুরির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সেখানে শেভরনের প্রেসিডেন্ট তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করার হুমকী পর্যন্ত দিয়েছেন।
৮।  ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসার পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচী নৈরাশ্যব্যঞ্জক।  তারা একটি সার্ভে কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে।  ওই কোম্পানির জরিপের পরই তারা শেভরনের সঙ্গে গ্যাসক্ষেত্র তিনটি ক্রয়ের বিষয়ে কথা বলবেন বলছেন।  প্রশ্ন হচ্ছে এর আগেই যদি শেভরন চীনা কোম্পনিকে গ্যাস ক্ষেত্র বুঝিয়ে দিয়ে ফ্লাই করে চলে যায়, তখন বাংলাদেশ কী করবে?
৯।  শেভরন বাংলাদেশ সরকারকে কেয়ারই করছেনা, তারা তাদের খেয়াল খুশি মতো কাজ করছে।
১০।  অতীতে ইউনিকল এবং নাইকো কর্তৃক বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়।  তারা আমাদের প্রচুর গ্যাস নষ্ট করেছে এবং নানাভাবে ঠকিয়েছে।
১১।  বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক দক্ষ জনবল তৈরী হয়েছে যারা নিজেরাই গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতে সক্ষম।
১২।  চীনের কাছে যে দামে বিক্রি করা হচ্ছে অর্থাৎ ২ বিলিয়ন ডলার, আদতে তার মূল্য অতো নয়, চীন মূলত জিও পলিটিক্সের অংশ হিসেবেই এখানে আসতে চাইছে।
১৩।  বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে শেভরনের এই অশুভ উদ্যোগ প্রতিহত করতে পারে এবং শেভরনের কাছে ন্যায্য দামে গ্যাসক্ষেত্র তিনটি কিনে নিতে পারে।

বাংলাদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নতুন নয়।  আমেরিকান কোম্পানিকে এদেশের তেল-গ্যাস ক্ষেত্র ইজারা দিতে রাজি না হওয়ায় শেখ হাসিনা সরকারকে একবার ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি বলে শোনা যায়।  সে কারণেই কি শেভরন এখানে খেয়াল খুশি মতো কাজ করছে এবং চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের অংশ চীনের কাছে বিক্রি করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে?  খনিজ তেল বাণিজ্য করে মধ্যপ্রাচ্যের গরীব দেশগুলো মাত্র কয়েক দশকে  বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও কোন ব্যর্থতার কারণে এই খাতে আমরা এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সফলতা দেখাতে পারিনি, ভেবে দেখা দরকার।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কী করে বিদেশি কোম্পানিগুলো এভাবে দাপট দেখাতে পারে, তা জাতিকে সত্যিই হতবাক করে দেয়।  শেভরণের আচরণে আমরা ইংরেজ শাসনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে পারি।  প্রথমে তারা এদেশে এসেছিলো মূলত ব্যবসা করার জন্যে। কিন্তু সেই ব্যবসায়ীরা কী করে কিছু মীরজাফরের মতো সুবিধাবাদী চক্রকে হাত করে মসনদ দখল করে দু’শো বছরের জন্যে উপমহাদেশকে শাষন, শোষন, লুটপাটের জায়গা বানিয়েছিলো আমরা ভুলিনি।  অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রকারন্তরে আমরা এখনো সেই বলয় থেকে মুক্ত হতে পারিনি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা এখনও আমাদের তেল-গ্যাস আমরা নিজেরা উঠাতে পারিনা, বিদেশি কোম্পানি লাগে, এটা সত্যিই বিস্ময়কর এবং লজ্জ্বাজনক।  এটা কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, নাকি রাজনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি অন্য কিছু জানা দরকার।
আমাদের বিপুল সংখ্যক দক্ষ কর্মী তৈরী হয়েছে যারা প্রযুক্তি সুবিধা পেলে নিজেরাই গ্যাসক্ষেত্রগুলো অপারেট করতে পারে।  শেভরনই কি প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ নয় যেখানে ৯৪ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশি?  আমাদের দেশিয় কোম্পানি তিতাস এর মতো কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতা চায়নার হিমালয়ার চাইতে বেশি।  সুতরাং কোন যুক্তিতে কিংবা কার ইশারায় সমস্ত নিয়মকানুন,  চুক্তির ধারাকে অগ্রাহ্য করে শেভরন এ ধরণের একটা কাজ করতে পারলো ভেবে দেখার সময় এসেছে।  শুধু তাই নয়, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে প্রযুক্তি আমদানীর মাধ্যমে দেশীয় প্রকৌশলী ও কর্মী দ্বারা  তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, আহরণ ও সরবরাহ কেন করা হয়না বা হচ্ছেনা, এর উত্তর কে দিবে? চীনের বদলে নিজেদের সম্পদ নিজেদেরই আয়ত্বে কেন রাখছি না, সেখানে কার বা কাদের স্বার্থ জড়িতে আছে সেটাও অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

আমাদের দেশে ‘তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি’ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। সম্প্রতি রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে তাদের আন্দোলন সংগ্রাম চোখে পড়ার মতো।  কিন্তু লক্ষণীয় যে- শেভরনের এই অপকর্মে  যখন দেশের স্বার্থ বিনষ্ট হচ্ছে, তখন তাদের কাউকে কিছু বলতে দেখছি না।  মিছিল-মিটিং দূরে থাক, একটা বিবৃতি পর্যন্ত নেই।  তবে কি আমরা ধরে নেবো যে- তাদের সব আন্দোলন সংগ্রামের টাকা আসে চীন থেকে, যে কারণে শেভরনের পক্ষ থেকে চীনা কোম্পানিকে  স্বাগত জানানোতে তাঁরা খুশি এবং ভারতীয় কোম্পানি কর্তৃক রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বলেই তাদের যতো গাত্রদাহ?

Facebook Comments Box

সাম্প্রতিক খবর:

বিশেষ অনুমতি ছাড়াই পাওয়া যাবে কুয়েতের ভিসা

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী গ্রেপ্তার

কুয়েতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

কুয়েতের কাজের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের অতিরিক্ত ৩০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হচ্ছে

চুরি হওয়া টাকা'ই ঋণের জন্য ব্যবহার হয়

ক্রোধের স্রোত অত্যাচারীদের ধ্বংস করে- আহমেদ আল-জারাল্লাহ

কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ মকবুল হোসেনের সফলতার গল্প

কুয়েতে ঈদুল ফিতর উদযাপিত এবং রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়

কান্না দেখে কাঁদছে হৃদয়, আমি মোটেও হৃদয়হীন নয়

হাসনাতের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তোলপাড় সোশ্যাল প্লাটফর্ম


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Sat, 24 May.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।