স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও তালিকা হয়নি একাত্তরের শহীদদের। তাঁদের আলাদাভাবে সম্মানিত করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে কবরসহ অনেকের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে গেছে সময় পরিক্রমায়। এমনই প্রেক্ষাপটে সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুনতাসীর মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই হয়নি। যাঁরা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করলেন, তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কোনো তথ্যানুসন্ধানও করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম সামছুল আরেফিন বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ কতভাবে শহীদ হয়েছেন তাঁদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু কতজন সশস্ত্র যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন সেই তালিকা না থাকাটা দুঃখজনক। কারণ মুক্তিযুদ্ধটা একটি সরকারের অধীনে, একটি কাঠামোর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শহীদদের যথাযথভাবে সম্মানিত করার জন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে এটা সম্ভব নয়।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের উপ-মহাব্যবস্থাপক (কল্যাণ) আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, বর্তমানে এক হাজার ৫৪১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা পাচ্ছে। ১৯৭৩ সালে ৭৫ টাকা ভাতা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ভাতার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অনেকের পিতামাতা ও স্ত্রী মারা যাওয়ার কারণে ভাতাপ্রাপ্ত পরিবারের সংখ্যা কমে এসেছে। আর নতুন করে কাউকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে। তখন যাঁরা আবেদন করেন তাঁদের সহায়তা প্রদান করা হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতামাতা, কিংবা স্ত্রী, কিংবা নাবালক সন্তানকে এই সহায়তা দেওয়া হয়। মূলত তখন যাঁদের পরিবার ভাতার জন্য আবেদন করেছিল তাঁদের নামেই গেজেট হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৯৩৮ জনের নামে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই তালিকার বিশুদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সে সময় অনেক পরিবার যথাযথভাবে তথ্য না পাওয়ার কারণে আবেদনই করেনি। পরবর্তী সময়ে শহীদের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হলেও এ-সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২২ মে পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রাথমিক অনুমোদন লাভ করে। সে অনুসারে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে গেজেটভুক্ত দুই হাজার ৯৩৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই ও কবর চিহ্নিত করার জন্য সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের গেজেটের কপিসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে জেলা প্রশাসকরা যে তালিকা পাঠিয়েছেন তাতে এক হাজার ৪০০-এর মতো মুক্তিযোদ্ধা কবর চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করা যায়নি। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান জানান, প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সবার কবর এখন আর চিহ্নিত করা নেই তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে ৩৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকারের নতুন উদ্যোগে একই নকশায় সব মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকাকরণ করে সংরক্ষণ করা হবে। নকশা দেখেই যে কেউ চিনতে পারবে সেটি বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। প্রতিটি কবরের এপিটাফে মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া থাকবে। একেকটি কবর সংরক্ষণে ব্যয় হবে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
এদিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক হাজার ৬৬৮ জন সদস্যকে সম্মাননা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ ভারতীয় রুপি করে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।