আ,হ জুবেদ:: পৃথিবীতে এমন সংখ্যা একেবারেই সল্প যে, প্রকৃত উদার মন আর প্রাণ খোলা মানুষের জন্ম হয়েছে,সীমিত হলেও আসলে আমাদের সমাজ সংসারে সেরকম মানুষ জন্মগ্রহণ করছে ঠিকই; কিন্তু উনারা অজ্ঞাত কারণে ঝরে পরছেন নির্জন অন্ধকারে নয়তো দেশ,জাতি ও সামাজ কাঁদিয়ে চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে অনেকটা অভিমানী মানুষটির বেশে।
তবে সেইসব ব্যতিক্রমধর্মী অভিমানী ব্যক্তিদের অনেকেই রেখে যান কিছু অনবদ্য স্মৃতি চিন্হ ও সফলতার উজ্জল স্বাক্ষর।
বোধকরি, যে সমাজে গুণীজনের কদর নেই; সে সমাজে গুণী তৈরি হয় না, একথার যথার্থতা আমরা এখন পাচ্ছি।
সৈয়দ মহসিন আলী একজন সেরকম’ই গুণীজন ও প্রকৃত উদার মন আর প্রাণ খোলা মানুষ ছিলেন।
এজগতে কোনো মানুষকেই আমরা মৃত্যুর পূর্বে খুবেকটা বুঝতে পারিনা, কিন্তু কারো বিয়োগ হলে পরেই, আমরা তার সম্পর্কে অনেক অজানা কথা জানি এবং সমাজে তার প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করি।
যেমন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুর পূর্বে উনার প্রয়োজনীয়তা আসলে খুবেকটা অনুমেয় ছিলনা। অথচ এই জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী যখন প্রাণহীন হলেন; তখন’ই গণমাধ্যমের প্রচার প্রচারণা ও দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে সত্যি সৈয়দ মহসিন আলী ছিলেন একজন গুণীজন ও প্রকৃত উদার মন আর প্রাণ খোলা মানুষ।
সৈয়দ মহসিন আলী যেমন ছিলেন প্রাণ খোলা একজন উদার মনের মানুষ; ঠিক তেমন’ই উনার মৌলভীবাজারস্থ সদরের শহরতলীর বাড়িটির প্রধান দরজাও খোলা ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সর্বক্ষণ।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ছিলেন একজন খ্যাতিমান ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি।
তিনি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১২ জানুয়ারি ২০১৪ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং একই দিন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গণে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধকালীন সিলেট বিভাগ সি.এন.সি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে সন্মুখযুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সন্মুখসমরে আহত হয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বাংলদেশকে শত্রুমুক্ত করতে সাহসী বীরের ভূমিকা রাখেন।
তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি সিলেট জেলা ও বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ মহসিন আলী তিনবার মৌলভীবাজার পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মহকুমা/জেলা রেডক্রিসেন্ট এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মৌলভীবাজার চেম্বারের সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি তাকে ‘আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক-২০১৪’ প্রদান করে এবং ‘হ্যালো কলকাতা’ নামে কলকাতাভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাকে ‘নেহেরু সাম্য সম্মাননা-২০১৪’ পুরস্কারে ভূষিত করে।
সৈয়দ মহসিন আলী ভারতের কলকাতা থেকে এমবিএ ডিগ্রি প্রাপ্ত। তিনি মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন স্থানীয় সরকারের আওতায় দেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে পরিবার পরিকল্পনা ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দী ভাষায় বলা ও লেখায় সুদক্ষ ছিলেন। সৈয়দ মহসিন আলী সরকারি ও ব্যক্তিগত সফরে ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি ভ্রমণ করেছেন।
মহসিন আলী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক ও জনদরদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত। সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আজ বহু অসহায় মানুষ দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
সৈয়দ মহসিন আলী ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সড়কের ‘দর্জি মহল’ এ এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। তার পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী এবং মাতা আছকিরুন্নেছা খানম। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ মহসিন আলী বিবাহিত এবং তিন কন্যা সন্তানের জনক। তিনি একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। খেলাধুলা, সঙ্গীত, বইপড়া ও শরীরচর্চা তার প্রিয় শখ।
সর্বশেষে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত’ই এ দায়িত্ব থাকালীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৌলভীবাজারবাসীর প্রিয় নেতা, প্রিয় মন্ত্রী এবং প্রিয় মহসিন ভাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তবে যাবার আগে সবাইকে বলে গেছেন আমার দরজা ২৪ঘন্টা খোলা থাকবে আপনাদের জন্য।