
একসময় সিলেটের মানুষের কাছে লন্ডন ছিল স্বপ্নের নগরী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, স্বজনদের বাধা উপেক্ষা করে অসংখ্য তরুণ পাড়ি জমিয়েছিলেন সেখানে। জীবিকার তাগিদে, উন্নত জীবনের সন্ধানে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। সময়ের পরিক্রমায় সেই যাত্রা এখন আর কেবল একটি পথের গল্প নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সিলেট থেকে হাজার হাজার মানুষের লন্ডনে পাড়ি জমানোর এই ধারা এখন এতই প্রবল যে, সিলেটকে অনেকেই ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ বলে থাকেন।
একটা সময় ছিল যখন সিলেটের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের লন্ডনে যেতে নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই মনোভাব বদলে গেছে। বর্তমানে সিলেটি পরিবারের তরুণ-তরুণীদের কাছে লন্ডন যেন এক নতুন দিগন্তের নাম। শখের বশে হোক বা উন্নত জীবনযাপনের জন্য, লন্ডন এখন তাদের কাছে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় যারা কৃষক বা নিতান্ত সাধারণ পরিবারের সদস্য ছিলেন, তারাও এখন লন্ডনে থিতু হয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।



বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকাংশই সিলেটের। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এক একটি ‘মিনি বাংলাদেশ’। যেমন, বার্মিংহামকে অনেকেই সিলেটের নবীগঞ্জ বলে থাকেন। এর কারণ, সেখানে হবিগঞ্জ জেলার মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। ঠিক তেমনিভাবে, ওয়েনচেস্টার অঞ্চলের চিত্রটাও অনেকটা একই। এখানকার সিলেটি প্রবাসীরা নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা রীতিমতো বাংলাদেশের গ্রামের আদলে ছোট ছোট কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খুশহালপুর গ্রামের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক মোহাম্মদ বাবুল মিয়া তার ঘরের আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করছেন, যা দেখে মনে হয় যেন বাংলাদেশেরই কোনো এক গ্রামের প্রতিচ্ছবি।
তবে প্রবাসে থাকা এই জীবনের দুটি ভিন্ন দিক রয়েছে। একদিকে যেমন নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি অন্যদিকে আছে শিকড় ধরে রাখার প্রবল টান। দেশের সচেতন মহলের অনেকেই মনে করেন যে, প্রথম দুই বা তিন প্রজন্ম পর্যন্ত হয়তো প্রবাসীরা বাংলাদেশ ও তাদের আত্মীয়-স্বজনকে মনে রাখবেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মরা হয়তো ধীরে ধীরে এই বন্ধন ভুলে যাবে। এই আশঙ্কা থেকে অনেকেই পরামর্শ দেন, বর্তমানে যারা লন্ডনে বসবাস করছেন, তাদের উচিত ঘন ঘন নিজেদের সন্তানদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা। এতে করে নতুন প্রজন্ম দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে এবং তাদের শিকড়কে ভুলে যাবে না।
লন্ডনে থাকা সত্ত্বেও সিলেটি প্রবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতি, খাবার এবং ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, ভৌগোলিক দূরত্ব তাদের মন থেকে তাদের দেশকে দূরে সরাতে পারেনি। তাই হয়তো সিলেটকে ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ বলার পাশাপাশি আমরা বলতে পারি, লন্ডনেও এক টুকরো বাংলাদেশ বেঁচে আছে।

আ হ জুবেদ (সম্পাদক, অগ্রদৃষ্টি)