ধর্ম ও দর্শন ডেস্ক: ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশের কাছে নিজেকে সন্তুষ্ট চিত্তে সঁপে দেয়া। তাঁর প্রতি ঈমান রাখা, তাঁর কাছে প্রতিদানের আশা করা এবং বিশ্বাস করা যে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনের মধ্যে রয়েছে কল্যাণ ও সফলতা। এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ তাআলা হলেন হাকিম বা মহাজ্ঞানী। তাঁর বিধানই পূর্ণাঙ্গ ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর। তার প্রতিটি বিধানে রয়েছে হেকমত বা কল্যাণকর মহা উদ্দেশ্য। অনেক সময় মানুষ তার বিধানের কল্যাণকর দিক ও হেকমত যথার্থ ভাবে অনুধাবন করতে পারে না। এটা মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। মানুষের কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন করা।
এ আদেশ-নির্দেশসমূহের হেকমত তথা বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও উপকারিতা অনুধাবন করতে পারা যাক বা না যাক। যদি এমন হয় যে আল্লাহর যে সকল বিধানের উপকারিতা আমাদের কাছে স্পষ্ট সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করব আর অন্যগুলো গুরুত্ব দেব না তাহলে তো আল্লাহর দাসত্ব করা হলো না। বরং নিজের মনের দাসত্ব করা হলো। এরূপ কেউ করলে এটা তার ঈমান ও বিশ্বাসের দুর্বলতার পরিচয় দিল। আবার এর অর্থ এটাও নয় যে আমরা আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধানের বৈজ্ঞানিক লাভ-ক্ষতি, উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারব না। অবশ্যই পারব, কারণ এটা আমাদের ঈমানকে আরো শক্তিশালী করবে, তাঁর প্রতি বিশ্বাসকে মজবুত করবে। তাই আমরা এখন সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ,তার কল্যাণ ও উপকারিতার দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ্ ।
(১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি :
এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সিয়ামের একটা লক্ষ্য হল মানুষ তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করবে। তিনি বলেন:
‘’হে বিশ্বাসীগণ ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।‘’( সূরা আল-বাকারা : ১৮৩)
তাকওয়া কী ? যা অর্জন করা যাবে সিয়াম পালন করলে।
তাকওয়া হল : আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করা আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এটা করা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভ ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে যখন বৈধ পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করতে পারে তখন সে অবশ্যই অবৈধ আচার-আচরণ, কথা ও কাজ এবং ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
(২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা :
শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় চলাচল করতে পারে। এবং কু-প্রবৃত্তি যদি যখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে তখন সে উদ্ধত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে। এবং সে তার আরো চাহিদা মিটানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় শয়তান ক্ষুধা ও পিপাসা দিয়ে এর সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সাহায্যে শয়তান ও কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এ কারণে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়াম নামক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেননা নফ্সে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সকল প্রকারের পাপাচারে লিপ্ত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন –
‘’হে যুবকেরা ! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ।“”
(বোখারি ও মুসলিম। )
সিয়ামের বিধানের এটা একটা হিকমত। এভাবেই সিয়াম মানুষকে তাকওয়ার পথে নিয়ে যায়। মোটকথা সিয়াম যাবতীয় জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও তা বৈধ পথে পরিচালিত করার প্রশিক্ষণ দেয়।
(৩) সিয়াম আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তার দাসত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ :
মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির গোলামি ও শয়তানের আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করবে তখনই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বান্দা বা দাস হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত তার সামনে আর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তাই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আদেশ-নিষেধকে নিজের প্রবৃত্তির দাবির উপর অগ্রাধিকার দেয়। এতে যত কষ্ট হোক, যত ধৈর্যের প্রয়োজন হোক, যত ত্যাগের দরকার হোক সব কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই সিয়াম পালনকারীকে দেখবেন সে দিনের বেলা খাচ্ছে না, খাচ্ছে রাতে, রাতে নিদ্রা যাচ্ছে না, রাত জেগে সে সালাত আদায় করছে। মিথ্যা কথা ও কাজ এবং সব ধরনের অসদাচরণ সে পরিহার করে চলছে । অথচ তার মন ও প্রবৃত্তি নির্দেশ দিচ্ছে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া করতে, রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে, মিথ্যা কথা বলতে ইত্যাদি। এমনিভাবে সিয়াম ও এ সম্পর্কিত কাজগুলো আদায় করার মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী প্রবৃত্তিসহ সকল মানুষের দাসত্ব অস্বীকার করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।
(৪) ধৈর্য, সবর ও দৃঢ় সংকল্পের প্রশিক্ষণ :
সিয়ামের মাস মূলত ধৈর্য ও সবরের মাস। সিয়াম মনের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়ার মাধ্যমে সংকল্পের দৃঢ়তার প্রশিক্ষণ দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন না করে তা মেনে চলার অভ্যাস গড়তে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। কখনো তাঁর সীমা লঙ্ঘনের কথা চিন্তা করে না। আল্লাহ তাআলা সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন :
‘’এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং এগুলোর নিকটবর্তী হয়ও না।‘’( সূরা বাকারা :১৮৭)
এর মাধ্যমে মানুষ নিজের মন ও বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ধরুন কোন ব্যক্তি একটি খারাপ অভ্যাসে লিপ্ত। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে এর থেকে বিরত থাকতে পারছে না। রমজান মাসের সিয়াম তার তার বদ অভ্যাস উৎপাটন করতে একটা বিরল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এরপর সে যেন আর বলতে না পারে যে আমি পারি না।
(৫) আখেরাতমুখী করার প্রশিক্ষণ :
সিয়াম পালনকারী পার্থিব সকল ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে দুনিয়ার প্রতি বিমুখ হয়ে আখেরাতমুখী হওয়ার দীক্ষা নিয়ে থাকে। তার এ ত্যাগ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখেরাতে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কিছুর জন্যে নয়। এ আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক কমিয়ে আখেরাতের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়ায় সবক নিয়ে থাকে। আর এ লক্ষ্য অর্জনে সে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্ম সম্পাদন ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে চেষ্টা করে।
(৬) আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া ও সৃষ্টি জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া :
অনুগ্রহের কথা ভুলে যাওয়া মানুষের একটি স্বভাব। অনুগ্রহ মূল্যায়ন করতে শেখে তখন, যখন সে তা হারিয়ে ফেলে। সিয়াম আদায়ের মাধ্যমে বঞ্চিত ও অভাবী মানুষদের দুরবস্থা অনুধাবন করতে শেখে। তখন সে যেমন তার প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলা-মীনের অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর শোকর আদায়ে যত্নবান হয় তেমনি বঞ্চিত, অভাবী, অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয় ও তাদের সেবা করতে উৎসাহ পায়।
(৭) শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা অর্জন :
সিয়ামের অন্যতম আরেকটি কল্যাণকর দিক হল স্বাস্থ্যের উন্নতি। নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে খাবার গ্রহণ, পরিমিত আহার, ঠিক একই সময় পানাহার আবার ঠিক একই সময় বিরতি দেয়া ইত্যাদি পাকস্থলীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশ্রাম দেয় ফলে পাকস্থলী শক্তিশালী হয়। এমনিভাবে ইসলাম প্রবর্তিত প্রত্যেকটি ইবাদত-বন্দেগিতে রয়েছে হিকমত ও মানুষের জন্য অসংখ্য পার্থিব কল্যাণ।
আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে তাঁর শান ও মান অনুযায়ী রামাদানে সিয়াম পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন !
লেখক :
ড. মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সহকারী অধ্যাপক,
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়,
ই-মেইল : mostafakabir_seu@ Yahoo.com