
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি ও নির্বাসিতদের মনস্তত্ত্ব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় একটি পুনরাবৃত্তিমূলক চিত্র প্রায়শই দেখা যায়: ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের দেশত্যাগ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে বহু মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এই নির্বাসিতদের একটি বড় অংশ আর কখনোই দেশে ফিরে আসেননি। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, বরং মানব মনের এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট: একাত্তর থেকে ৯০-এর দশক
১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানপন্থী বা রাজাকার হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই দেশ ছেড়েছিলেন। কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদে, তাদের বেশিরভাগই আর বাংলাদেশে ফিরে আসার সাহস বা সুযোগ পাননি। ৯০-এর দশকে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর একই চিত্র দেখা যায়। তার শাসনামলের সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি দেশ ছেড়েছিলেন এবং তাদেরও অনেকে আর দেশে ফেরেননি। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, এবং ২০০৭ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বহু নেতাকর্মীকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তাদেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসে নতুন জীবন শুরু করেন এবং আর স্বদেশে ফিরে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি।
২০২৪ সালের প্রেক্ষাপাপট: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর যেসব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দেশ ছেড়েছেন, তাদের ভবিষ্যৎও সম্ভবত একই পথে হাঁটবে। প্রাথমিক পর্যায়ে হয়তো তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বা ফেরার আকাঙ্ক্ষা কাজ করবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মানসিকতা পরিবর্তিত হয়। বিদেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি সুযোগ পেলে, অধিকাংশ মানুষই আর পেছনে ফিরে তাকাতে চাইবেন না।
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান:
- নতুন জীবন ও স্থিতিশীলতা: প্রবাসে জীবন শুরুর প্রথম কয়েক বছর কঠিন হলেও, এক পর্যায়ে যখন তারা আর্থিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেন, তখন তাদের মধ্যে দেশে ফেরার আগ্রহ কমে আসে। উন্নত জীবনযাত্রা, সন্তানদের জন্য ভালো শিক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ তাদের কাছে দেশের অনিশ্চিত রাজনৈতিক জীবনের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।
- ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা: দেশে ফেরার পর রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয় তাদের মধ্যে সবসময় কাজ করে। বিদেশের নিরাপদ ও স্থিতিশীল জীবন ছেড়ে এই ধরনের ঝুঁকি নিতে তারা সাধারণত আগ্রহী হন না।
- মানসিক বিচ্ছিন্নতা: দীর্ঘকাল বিদেশে থাকার ফলে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে তারা মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দেশের সমস্যা বা সংঘাত তাদের কাছে দূরবর্তী বিষয় বলে মনে হয়।
নির্বাসিতদের মনস্তত্ত্বের গভীরে
যারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেশ ছেড়েছেন, তাদের কাছে এক সময় নিজ দেশ একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, নতুন সম্পর্ক তৈরি করা এবং নিজেদের একটি নতুন পরিচয় গড়ে তোলার পর তাদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আসে। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও, বাস্তবতার নিরিখে তারা নতুন জীবনকেই বেছে নেন। এই নির্বাসিত মানুষগুলোর গল্প প্রমাণ করে যে, একবার দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, ঘরে ফেরার পথটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণে প্রায়শই বন্ধ হয়ে যায়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি ট্র্যাজিক পুনরাবৃত্তি, যা ভবিষ্যতেও একইভাবে চলতে থাকবে বলে মনে হয়।

আ হ জুবেদ (সম্পাদক, অগ্রদৃষ্টি)