ধর্মীয় দর্শন ডেস্কঃ চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই মাসের সঙ্গে বাঙালি ও বাংলাদেশীদের রয়েছে একটা প্রাণের সম্পর্ক। আল্লাহ পাক মানুষকে যত নিয়ামত দান করেছেন এর মধ্যে অন্যতম সেরাটি হলো ভাষা। ইসলাম প্রতিটি ভাষাকেই বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ার কারণে একমাত্র আরবি ছাড়া সব ভাষার স্তর প্রায় এক। তবে ইসলাম বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতি।
কালের পরিক্রমায় যত নবী-রাসুল দুনিয়াতে এসেছেন ঐশী বার্তা নিয়ে তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন স্ব স্ব মাতৃভাষার পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। নবী-রাসূলদেরকে মাতৃভাষায় দক্ষ করে পাঠানোর কারণ হলো, তারা যেন স্বজাতির কাছে যথার্থভাবে দাওয়াত উপস্থাপন করতে পারে।
বাংলা ভাষা অধ্যুষিত আমাদের এই ভূখণ্ডে কোনো নবী-রাসুল এসেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। এতদ অঞ্চলে কোনো নবী বা রাসুল এলে অবশ্যই তিনি হতেন বাংলাভাষী। বাংলা ভাষাকে নির্ভর করেই পরিচালিত হতো তার দাওয়াতি মিশন।
তবে নবী-রাসূল না এলেও যুগে যুগে যারা নবী-রাসুলদের মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন তারা ছিলেন বাংলাভাষী। তাদের দাওয়াতি কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ঘটেছে বাংলাকে কেন্দ্র করেই।
সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পীর, ওলি, দরবেশ, আলেম যারাই এতদ অঞ্চলে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রত্যেকেই বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। তাদের এই ব্যাপক স্বীকৃতির ফলে বাংলা দাওয়াতি ভাষার মর্যাদায় যেমন অভিসিক্ত হয়েছে তেমনি ইসলামি সমাজ, ভাবধারা ও মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়েছে।
ভাষা হিসেবে বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও প্রাচীন। এদেশে বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বের চেয়ে ইসলাম আগমনের সময়সীমাটি কম নয়। তবে বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে অষ্টম শতাব্দীতে, আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলামের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে আরো কয়েক শতাব্দী পরে।
১২০৩ সালে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
মুসলিম শাসনের সূচনাকাল থেকে পলাশীর বিপর্যয় অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এই সাড়ে পাঁচশ বছর ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত অর্থে স্বর্ণকাল। বাংলার মুসলিম শাসকরা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বাংলা চর্চার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিদদেরকে মুসলিম রাজা-বাদশারা বিশেষ আনুকূল্য প্রদান করতেন। সে সময় রাজ দরবারগুলো ছিল শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকেন্দ্র। মধ্য যুগে মুসলিম লেখকদের হাতে জন্ম নেয়া সাহিত্য বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছে।
সংস্কৃতির অন্যতম বাহন ভাষা। আর ধর্ম হলো সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান। ভাষাকে বাহন করে যে সংস্কৃতি বিকশিত হয় তাতে ধর্মীয় ছাপটা মোটাদাগে ধরা পড়ার কথা। এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই।
স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাসের ছোঁয়া লেগেছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে। আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে ইসলামী আবহের স্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন ছাপ যেমন পরিলক্ষিত হয় তেমনি এদেশের ভাষাও তা থেকে মুক্ত নয়।
মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের ঐকান্তিকতা ও সাধনায় আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানিত্বের প্রভাবটা দিন দিন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। নিজেদের অজান্তেই নিরেট ইসলাম ও মুসলিমবান্ধব অগণিত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা ভাষায়।
তাছাড়া আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার ভাণ্ডার থেকে আহরিত যে সম্পদ আজ বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে গণ্য হচ্ছে তা মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকদের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। সংস্কৃত থেকে বাংলার মূল উৎপত্তিস্থলটার কথা বাদ দিলে বাংলা ভাষা বিকাশের পরবর্তী প্রতিটি বাঁকে মুসলিম মনীষীদের অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম পণ্ডিতেরা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সেই বীরদের অবদান চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে।
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই