২৪ আগস্ট, ২০০৯! দ্বিতীয় রমজান! আট আটটি বছর! আমার সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত মানুষকে হারানোর বছর। আমি, আমরা হারিয়েছিলাম আমার প্রাণপ্রিয় বাবাকে। আমরা বাবাকে আব্বা বলে ডাকতাম! মানুষটা কঠিনে কোমলে মেশানো এক মানুষ ছিলেন। কাঠিন্য অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হলেও মানুষকে ভালবাসতেন হৃদয়ের কোণে লুকিয়ে থাকা অধিকতর কোমলতার পরশ দিয়ে। আমি সেই বাবার সন্তান।
৬ ফুট উঁচু মানুষটি কখনো পেছন ফিরে ঘাড় বাঁকিয়ে কথা বলতেন না! বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, নীতিবান ব্যবসায়ী এবং চরম দূরদর্শী একজন মানুষ ছিলেন আমার বাবা! বাবার দেখানো কাঠিন্যের কারণেই আমরা বাবাকে ঠিক মায়ের মতো জড়িয়ে ধরে ভালবাসতে পারতাম না! যদিও ভালবাসার বিশাল সমুদ্র ছিল আমার বুকে আমার বাবার জন্য!
মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে পাঁচ পাঁচটি সন্তানকে যথাযথভাবে মানুষ করা চাট্টিখানি কথা নয়!! বাবার ব্যবসায়ের খারাপ সময়টি আমি পাইনি, শুনেছি! ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর, এর মাঝে কারো কাছে সহযোগিতা না নিয়ে আমার বাবা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, এই বিষয়টিই আমাদের কারো কাছে মাথা নত করতে শেখায়নি।
সন্তানদের আবদার রক্ষা করা, কখনো কষ্ট অনুভব করতে না দেয়া এসব বুঝি বাবারাই পারেন। বাবাদের যেন কষ্ট পেতে নেই!
আব্বাকে অনেকদিন দেখি না। যখন আব্বার কবরে যাই শান্তি শান্তি লাগে, মনে হয় আব্বা কান পেতে শোনেন আমাকে। আমি জানিনা আমার ভাই বোন বড় হয়ে আমার বাবাকে চুমু খেতে পেরেছিল কি না?! আমি খেয়েছিলাম সেই সাথে ৩০ মিনিট বাবাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। মারা যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটি।
আব্বা মারা যাওয়ার সম্ভবত এক বছর আগে আমরা আব্বাকে রেনাল হাসপাতালে ভর্তি করাই। রাতে আমি ছিলাম আব্বার সাথে। এত সাহসী মানুষটা কেমন ভয় পাচ্ছিলেন, আমাকে বললেন, বাবা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর!! আমি ঠিক কত ঘণ্টা আব্বাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার চোখ দুটো নোনা জলে বারবার ভিজে উঠছিল।
আব্বাকে ভীষণ মিস করি। নাহ শুধু বাবা দিবসে আমার বাবাকে আমি স্মরণ করি না। প্রতিদিন প্রতিটি নামাজের ওয়াক্তে আব্বা আমার স্মরণে আসেন। ওহ হ্যাঁ, আব্বাকে আমরা আপনি করে বলতাম, তাতে কী ভালবাসা কিন্তু কখনোই কমেনি তাতে!!
আমার আবেগের জায়গার বেশি অংশ জুড়ে আমার মা, তাই সত্যি করে মনে হয় বাবার প্রতি আমার ভালবাসা প্রদর্শন কম হয়েছে, যা আমাকে তীব্র কষ্ট দেয়। যখন দেখি অনেকের বৃদ্ধ বাবা এখনো আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে বেঁচে আছেন, তখন তীব্র কষ্ট হয়! ৫৫ বছর তখন খুব অল্প সময় ঠেকে আমার কাছে।
আব্বাকে জড়িয়ে তো ধরেছি, কিন্তু কখনো বলিনি আব্বা আপনাকে অনেক অনেক ভালবাসি। ইস্ যদি একবার সুযোগ পেতাম একটি মিনিটের জন্য, তাহলে চুমোতে চুমোতে আব্বার মুখটা ভরিয়ে দিতাম আর বলতাম আব্বা আমি আপনার ছোট ছেলে, আপনাকে পাগলের মতো ভালবাসি!!!
আমার এ আকুতি, আমার এ কান্না আমার বাবা শুনছেন তো!! আর লিখতে পারছি না, চোখ জ্বালাপোড়া করছে!! পৃথিবীর সব বাবা মা বেঁচে থাকুন!
ইশ্বরী পাটনীর বাক্যটি পাল্টে দেই ‘আমার বাবা মা যেন থাকে দুধে ভাতে’!! বাবা-মাকে ভালবাসুন হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। খুব সৌভাগ্যবান মানুষের বাবা-মায়েরাই বেঁচে থাকেন। পৃথিবীর সকল বাবারা অশ্বত্থ বৃক্ষ হয়ে ছায়া হয়ে থাক সন্তানের মাথার উপর- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক :
ইফতেখায়রুল ইসলাম
সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ডেমরা জোন)
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই