
জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় ৫৪ বছরের, কিন্তু বাঙালি হিসেবে আমাদের শিকড় শত শত বছরের প্রাচীন। দীর্ঘ এই পথচলায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নিয়েছি। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পরেও আমাদের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনায় এক গভীর স্থবিরতা লক্ষ্য করা যায়, যার মূল কারণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক ত্রুটি।
দেশের অভ্যন্তরে বা বিদেশে। যেখানেই হোক না কেন–দুই জন বাংলাদেশি নাগরিকের সাক্ষাতে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক মেরুকরণ। কে কোন দলের নেতা-সমর্থক কে কাকে সমালোচনা করলো, কোন দল কী অর্জন করলো বা হারালো—এই হলো আমাদের আলাপচারিতার সারমর্ম। আমরা যেন ব্যক্তি বা তার কর্মপরিচয়কে ছাপিয়ে দলীয় লেবাসকেই একমাত্র পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছি।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের নাগরিকদের দিকে তাকালে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। বিদেশে তাদের পরিচয়: “উনি একজন ডাক্তার, ইনি প্রকৌশলী, তিনি একটি কোম্পানির ম্যানেজার।” তাদের কর্মক্ষেত্রেও আলোচনার কেন্দ্রে থাকে দায়িত্ব, কাজ, এবং কেরিয়ার বা পেশাগত উন্নতি। তারা একে অপরকে সহযোগিতা করে কীভাবে আরও ভালো অবস্থানে যাওয়া যায়। সেখানে পারস্পরিক মূল্যায়ন হয় যোগ্যতা, দক্ষতা ও অর্জনের নিরিখে, কোনো রাজনৈতিক তকমা দিয়ে নয়।
এটাই হলো আসল পার্থক্য। আমরা নিজেদের আলোচনাকে রাজনীতির সংকীর্ণ বৃত্তে আবদ্ধ করে ফেলেছি। এই দলীয় আনুগত্য ও রাজনৈতিক রেষারেষি আমাদের মনন ও মানসিকতাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, আমরা ব্যক্তিগত কেরিয়ার, জাতীয় কল্যাণ কিংবা বৃহত্তর স্বার্থের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছি। যখন আমরা একে অন্যকে সম্মান জানাই বা মূল্যায়ন করি, তখনও সেই বিচারের মাপকাঠি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পক্ষ বা বিপক্ষ।
একটি দেশ বা জাতি তখনই সত্যিকারের উন্নতিসাধন করতে পারে, যখন তার নাগরিকেরা ব্যর্থ সমালোচনা ও নিছক রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর থেকে বেরিয়ে এসে গঠনমূলক কাজ ও পেশাদারিত্বকে অগ্রাধিকার দেয়। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, প্রযুক্তি—এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও জাতীয় অর্জনই হওয়া উচিত আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি। ব্যক্তির মেধা, শ্রম ও অবদান যখন আমাদের মূল্যায়নের কেন্দ্রে আসবে, তখনই আমরা সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠে জাতীয় উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।
রাজনীতি সমাজের একটি অংশ, তার সর্বস্ব নয়। আমাদের এই অভ্যাসগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা আজ সময়ের দাবি। রাজনীতির বাইরেও একটি বিশাল জগৎ আছে—যেখানে কর্ম, সৃষ্টিশীলতা ও নিষ্ঠাই মানুষকে মহিমান্বিত করে। আসুন, দলীয় পরিচয়ের পরিবর্তে নিজেদের কর্মদক্ষতা ও পেশাগত সাফল্যকে আমাদের প্রধান পরিচয় হিসেবে তুলে ধরি। একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির এই মৌলিক পরিবর্তনই আমাদের জাতিকে কাঙ্ক্ষিত উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।
