বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের নানা কারণে মৃত্যু হচ্ছে, তবে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে প্রবাসীদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
গত ১৫ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪১ হাজার প্রবাসীর লাশ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে শুধুমাত্র কুয়েতে বিভিন্ন কারণে গত ১৫ বছরে ২৯২৭ জন প্রবাসী মৃত্যুবরণ করেছেন, এদের মধ্যে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৫৮৫ জন, বাকিরা হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে প্রাণ হারিয়েছেন। সরকারি খরচ ও বিমানের ফ্রি টিকেটে ৮৪০ প্রবাসীর মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়, ৩৫ প্রবাসীর মরদেহ স্থানীয়ভাবে দাফন সম্পন্ন হয় এবং বাকি মরদেহ গুলো মৃতব্যক্তির স্পন্সর ও আত্মীয়-স্বজনদের উদ্যোগে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।
কুয়েতে গত ১৫ বছরে মৃত্যুর মোট সংখ্যার অনুপাতে গড়ে প্রতি বছর ১৯৫ জন ও প্রতি মাসে ১৬ জন প্রবাসী মৃত্যুবরণ করেছেন।
সবচেয়ে বেশি প্রবাসী প্রাণ হারান ২০১৯ সালে, বিগত এ বছরটিতে ২৫৬ প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে, এদের মধ্যে দুর্ঘটনা জনিত কারণে- ২৫, আত্মহত্যায়- ৩ সহ আরো নানা কারণে ২২৬ জন প্রবাসী মৃত্যবরণ করেছেন।
অর্থাৎ গত বছর গড়ে প্রতি মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন ২১ জন প্রবাসী।
কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে, ২০০৫ সালে ২০১ জন, ২০০৬ সালে ২৩৩ জন, ২০০৭ সালে ২০৭ জন, ২০০৮ সালে ১৮৬ জন, ২০০৯ সালে ১৬৯ জন, ২০১০ সালে ১৮৩ জন, ২০১১ সালে ১৮৬ জন, ২০১২ সালে ১৪৬ জন, ২০১৩ সালে ১৮০ জন, ২০১৪ সালে ১৮৭ জন, ২০১৫ সালে ২০১ জন, ২০১৬ সালে ২০০ জন, ২০১৭ সালে ২১৮ জন, ২০১৮ সালে ১৭৪ জন ও ২০১৯ সালে ২৫৬ জন প্রবাসীর।
কিছুদিন আগে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯৪ শতাংশ প্রবাসীদের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে, এদের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ৩০ শতাংশ, বাকিরা হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যানসার, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন।
অন্যদিকে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব মধ্য বয়সী কর্মীদের লাশ বাংলাদেশে গিয়েছে তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু স্ট্রোকের কারণে।
এছাড়া গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ গিয়েছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে। আর এসব প্রবাসীদের বয়স ২৮ থেকে ৪০ এর মধ্যেই ছিল।
বাংলাটিভিতে প্রচারিত ”প্রবাসীর ডাক্তার” অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ও লেখক ডাক্তার ফারহানা মোবিন, প্রবাসীদের নানা রোগের চিকিৎসা বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
তার মতে প্রবাসীদের রোগাক্রান্ত হওয়ার পিছনে অনেক গুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ গুলো যথাক্রমে, প্রতিকূল পরিবেশ, যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম এবং একই সঙ্গে বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তা, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো ঘটনায় প্রবাসীরা আকস্মিক প্রাণ হারাচ্ছেন।
ডাক্তার ফারহানা মোবিন বলেন, সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত ডাক্তার এর সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে, নিজে আরো সচেতন হতে হবে, তবেই সুস্থ থাকা সম্ভব, এবং এতে করে প্রবাসী মৃত্যুর সংখ্যাও কমে আসবে।
কুয়েতের আব্বাসিয়া এলাকায় অবস্থিত রয়াল সিটি ক্লিনিকে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশী ডাক্তার নাজমা তালুকদার এর দৃষ্টিতে এ দেশটিতেও ৩৫/৪০ এর মাঝামাঝি বয়সে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে প্রবাসীদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হচ্ছে।
নানা কারণে কুয়েতে প্রতি বছর বহু প্রবাসী প্রাণ হারাচ্ছেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে তিনি বলেন, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগ।
আর এসব রোগের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব উল্লেখ করে ডাক্তার নাজমা তালুকদার প্রবাসীদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি শরীর চর্চারও পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, যেকোনো প্রবাসী নন্যুতম শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করলে নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নেয়া অত্যন্ত জরুরী।
তিনি আরো বলেন, একটু সচেতন হলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কুয়েত প্রবাসীদের মরদেহ দ্রুত বাংলাদেশে পাঠাতে কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এ কথা উল্লেখ করে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম জানান, বছর তিনেক আগে কুয়েতে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ সদস্যের মৃত্যুর হয়, সেসব প্রবাসীদের মরদেহ দুদিনের মধ্যে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।
বাংলাদেশে মরদেহ পাঠানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার উপর নির্ভর করে দূতাবাসের দ্রুততম কার্যক্রম এবং এসব কাজে দূতাবাস বরাবরই খুবই আন্তরিক বলেও জানান রাষ্ট্রদূত।
প্রবাসীদের অসচেতনাই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মূল কারণ উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, সময় ও পরিস্থিতি অনেক সময়ই নিজেদের অনুকূলের বাইরে চলে যায়, এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। তিনি প্রবাসীদের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যতটুকু সম্ভব চিন্তামুক্ত থাকার পরামর্শ দেন।
কুয়েতে বসবাসরত সমাজ সচেতন মহল মনে করছেন, কুয়েত প্রবাসীদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মূল কারণটিই হচ্ছে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব।
এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস অথবা বাংলাদেশ কমিউনিটির উদ্যোগে প্রতি মাসে কিংবা দুই মাস পর পর একটি সেমিনার করার পরামর্শ দিয়েছেন কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
সম্পাদক- আ হ জুবেদ