এই ব্যস্ত শহুরে কর্মজীবনে দুপুরের খাবার পরে একটু ঘুমের জন্যে শরীরটা কেমন আকুলিবিকুলি করে তা একজন কর্মী মাত্রই জানেন। সকালবেলায় এ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে ঘুম থেকে উঠলেন, আধা ঘন্টার মধ্যে সকালিক চাহিদাগুলো পূরণ করে বাসে চেপে বসলেন, অফিসে গিয়ে তুমুল গতিতে কাজ শুরু করলেন চনমনে মন নিয়ে, এসব পর্যন্তই সবকিছু ঠিক থাকে। কিন্তু লাঞ্চের পরেই শরীরটা বিগড়ে বসে। আহ্লাদী প্রেমিকার মত সে ইনিয়ে বিনিয়ে আপনার কাছ থেকে ঘুম চায়। একটি বালিশ আর বিছানা চায়। এই সময়টায় কর্মস্পৃহা এবং গতি দিনের অন্যান্য যে কোন সময়ের চেয়ে খারাপ থাকে। আপনার ৩-৪ ঘন্টার বিশাল এ্যাক্সিডেন্টাল ঘুমের দরকার নেই। দুপুরের এই থমকানো ক্লান্তিকে দূর করতে ২ থেকে ২০ মিনিটের একটি ছোট্ট ঘুমই যথেষ্ট। নামী দামী ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকের চেয়ে এটি অনেক বেশি কার্যকর।
প্রায় ৮৫% স্তন্যপায়ী প্রাণীই সারাদিনে স্বল্প সময়ের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ে একাধিক বার। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাভাবিক রুটিন মেনে চলা যেকোন মানুষেরই দুপুরবেলায় ঘুম পেতে পারে। এজন্যে লাঞ্চ দায়ী নয়। আমাদের দেহঘড়িটাই এমনভাবে প্রোগ্রামড করা। ঠিক দুক্ষুর বেলা ঘুমে মারে ঠেলা!
দুপুরবেলার ঘুম আমাদের কী উপকার করে?
কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে- ক্লান্তি দূর করে মাথার ভেতর পাকিয়ে ওঠা জটগুলো পরিষ্কার করে। সৃজনশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ভুলের পরিমাণ হ্রাস পায়। বেড়ে যায় উদ্দীপনা, একটি সুন্দর ঝরঝরে অনুভূতি কাজের প্রতি বিশ্বস্ততা বাড়িয়ে দেয়।
মনোযোগ- NASA’র গবেষণায় দেখা গেছে, একটি সুন্দর দুপুরতন্দ্রা কাজের দক্ষতা ১০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করে! ৩৪% পর্যন্ত কাজের প্রতি মনোযোগ এবং ডেডিকেশন বাড়িয়ে দিয়ে দারুণ চনমনে রাখে।
সুখ সুখ অনুভূতি- চাপ দূর করে সুখের অনুভূতি তৈরি করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে দুপুরের ছোট্ট ঘুম সেরোটোনিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এই সুন্দর ভালো থাকার অনুভূতি তৈরি করে।
স্মৃতি- মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। জমে থাকা পুরোনো এবং অপ্রোয়জনীয় তথ্যগুলো সরিয়ে দিয়ে নতুন তথ্য পরিবহন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
হৃদয়ঘটিত ঘটনা- মানুষের হৃদয় বড় বিতিকিচ্ছিরি জিনিস। কখন যে বিগড়ে যায় ঠিক নেই। তবে আশার কথা, দুপুরের ঘুম হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। যারা সপ্তাহে তিন দিন ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঘুমায় তাদের হৃদয়ঘটিত জটিলতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ৩৭% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
মস্তিষ্কের রোগ- এই একরত্তি পুচকে ঘুমটি মস্তিষকে সচল রাখে। যার ফলে ডিমেনশিয়া এবং আলঝেইমারের মত কঠিন অসুখ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ত্বক মেরামত- সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে ত্বক মেরামতের সাথে ঘুমের কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, স্কিন রিপেয়ারিংয়ে এই বিশেষ সময়ের ঘুমটি বেশ কার্যকর।
ওজন সমস্যা- তন্দ্রাছন্নতাকে জোর করে চাপিয়ে রাখলে পাকস্থলী থেকে ঘ্রেলিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। অপরদিকে ছোট্ট ঘুমের চর্চা ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ওজন বাড়তে না দেয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা- দুপুরবেলায় সময়মত না ঘুমোলে কর্টিজল নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সময়মত ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
আপনি কেমন ঘুমাচ্ছন্ন?
ঘুমের সময়সীমা এবং গঠন বিশ্লেষণ করে বেশ কয়েক রকম ঘুম অভ্যেস পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক। চলুন জেনে নেই,
পরিকল্পিত ঘুম- এক ধরণের মানুষ একটু বেশি সাবধানী। কিছুটা সৌভাগ্যবানও বটে। কারণ তারা যখন চায় তখনই ঘুমোতে পারে। ক্লান্তি এড়াতে ঠিকমত তন্দ্রা আসার আগেই তারা ঘুমিয়ে নেয় বেশ একচোট।
শক্তিশালী ঘুম- দুপুর একটা থেকে চারটার মধ্যে যেকোন এক সময়ে ২০ মিনিটের মত ঘুমিয়ে নেয় তারা।
অতি ক্ষুদ্র ঘুম- ২-৫ মিনিটের ঘুমেই অনেকে সতেজ হয়ে ওঠে।
অতি জরুরী ঘুম- কেউ কেউ হঠাৎ করেই ঘুমের প্রচণ্ড চাহিদা অনুভব করে। তৎক্ষণাৎ ঘুমোতে না পারলে তারা বড় বিপদে পড়ে যায়। তাদের কর্মক্ষমতা এবং মনোযোগ বহুলাংশে হ্রাস পায় সেই সময়ের জন্যে।
রুটিন ঘুম- এই ধরণের ঘুমাচারীরা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন ঘুমিয়ে থাকেন।
বিখ্যাত দুপুর ঘুমাচারীরা
উইনস্টন চার্চিল- দ্যা গ্যাদারিং স্ট্রম বইয়ে তিনি বলেছেন, “প্রকৃতি চায় না তার সন্তানেরা সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ঘুম নামক সেই অসাধারণ আশীর্বাদটি ছাড়াই কাজ করে যাক। ঘুম, কী মূল্যবান এক আশীর্বাদ! দুপুরের ২০ মিনিট ঘুমেই পুনরুদ্ধার হয় পুরো দিনের কর্মশক্তি। “
জন এফ কেনেডি- তিনি প্রতি দুপুরে একটি ২ ঘন্টার ঘুম দিতেন। কোন বিশেষ জরুরী অবস্থা ছাড়া তাকে ডাকা নিষেধ ছিলো।
সালভাদর ডালি- এই প্রতিভাধর স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী দিবানিদ্রাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন সবসময়। “স্লাম্বার উইথ আ কি” নামক এক উদ্ভট কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি দুপুরে ঘুমোতেন, এবং তিনি এটাকে চিত্রশিল্পী হবার জন্যে একটি গুরুত্বপূ্র্ণ চর্চা হিসেবে গণ্য করতেন।
দুপুর ঘুমের অনুঘটক এবং উপাদানেরা
সময়- ঘুমের জন্যে ত্রিশ মিনিটের বেশি সময় বরাদ্দ রাখবেন না। আপনার শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এটুকু সময়ই যথেষ্ট। এর বেশি হলে রাতে ঘুম আসতে দেরি হতে পারে আর ঘুম থেকে ওঠার পরে টলটলায়মান ঘোলাটে বাজে একটি অনুভূতি তৈরি হতে পারে।
পরিবেশ- শান্ত এবং নিরুপদ্রব পরিবেশ নির্বাচন করুন, যেখানে তাপমাত্রা আরামদায়ক এবং শব্দদূষণ নেই। বেশি আলো থাকলে আই মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।
রুটিন- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমান এবং জেগে উঠুন।
দেহঘড়ি- সবসময় নিয়ম মেনে ঘুম আসে না। তাই আপনার দেহঘড়ির টিক-টকটা শুনুন এবং বুঝুন। বিশেষ করে দুপুর ২-৩টার মাঝে। এই সময় কর্ম উদ্দীপনা এবং মনোযোগ ব্যাপকভাবে হ্রাস হবার সম্ভাবনা থাকে।
ক্যাফেইন- ঘুমোনোর আগে এক কাপ কফি খান। এটি আপনাকে ঠিক সময়ে জেগে উঠতে সাহায্য করবে।
ঘুমচক্র
প্রথম ধাপ- (ঘুম এবং জাগরণের মধ্যবর্তী অবস্থা)- এর দৈর্ঘ্য ৫-১০ মিনিট। ক্লান্তি দূর করে, এবং স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে দুপুরবেলার কাজের জন্যে প্রস্তুত করে।
দ্বিতীয় ধাপ- (শক্তি আনয়নকারী)- ১০-২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ঘুম। সচকিত এবং প্রফুল্ল করে তোলে। ভারসাম্যহীন টালমাটাল শারীরিক অবস্থায় চমৎকার সমতা এনে দেয়।
তৃতীয় ধাপ – (বর্ধিত শক্তি)- বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকেন, দুপুরবেলায় একটু ঘুমিয়ে নিজেকে কর্মচঞ্চল এবং সতেজ করতে ২৬ মিনিটের ঘুমই আদর্শ। ৩০ মিনিটের বেশি ঘুমকে তারা নিরুৎসাহিত করেন।
চতুর্থ পর্যায় (গভীর ঘুম) – স্মৃতি ব্যবস্থাপনায় ভালো ফল এনে দিলেও ঘুমঘুম ভাব চোখের মাঝে রয়েই যায় এবং গেড়ে বসার সম্ভাবনা থাকে।
REM (Rapid eye movement) – আরো গভীর! ৯০ মিনিটের ঘুম। এই ঘুমে মানুষের চোখের পাতা স্পন্দিত হতে থাকে। একেবরে স্বপ্ন দেখা গভীর ঘুম! কাজের পরিবেশে এমন ঘুম কখনই কাম্য নয়।