ধর্মীয় দর্শন ডেস্কঃ আনুগত্য হচ্ছে ইসলামের মূল। আনুগত্য ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারে না। মুসলিম মানেই অনুগত, আত্মসমর্পণকারী। আল্লাহ্ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর বিধানের অনুগত বান্দাই মুসলিম। তাই সে আল্লাহরই আজ্ঞাবহ। তাঁর বিধিবিধান সানন্দে পালন করে। এতে নবী-রাসূলদের (আ.) স্থান সর্বাগ্রে। তাঁরা সরাসরি আল্লাহ্ তায়ালার কাছ থেকে নির্দেশিত হতেন এবং তাঁরই সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সর্বপ্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদেরকে আল্লাহর হুকুমের কাছে উৎসর্গ করতেন।
কুফর মিশ্রিত ঈমান ও বস্তুবাদী চিন্তাধারায় তাঁদের প্রতি আল্লাহর অনেক নির্দেশই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক (নাঊযুবিল্লাহ্) এবং তাঁদের দ্বারা তা পালন ও এর ফলাফল অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। মূলত তাই ছিল সঠিক ও কল্যাণকর। যেমন- নবী ইব্রাহীম (আ.) এর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া ও পুত্রকে কুরবানী দেওয়া; মূসা (আ.) কে ফিরআঊনের ধাওয়া কালে লাঠি দিয়ে নদীতে আঘাত করা এবং সাইয়্যিদানা রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কে কুরাইশ কর্তৃক ঘেরাও কালে নিরস্ত্র অবস্থায় বের হওয়ার নির্দেশ ও তা পালন করাকে বস্তুবাদী জ্ঞানে বোকামীই বলা হতে পারে। অথচ এতেই ছিল সফলতা। অন্যথায় তাঁরা যদি আল্লাহর আনুগত্য না করে ইবলিসের মত যুক্তি দেখাতে যেতেন, তবে তার মত তাঁরাও অভিশপ্ত হওয়া থেকে রেহাই পেতেন না।
মূসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য না করে বলতে পারতেন, লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করার চেয়ে ফিরআঊন বাহিনীর দিকে আঘাত করার যৌক্তিকতা বেশী। আমাদের নবী (সা.) বলতে পারতেন, খালি হাতে বের হওয়ার চেয়ে অন্তত ঘরের একটি খুঁটি ভেঙ্গে হাতে নিয়ে বের হওয়া যুক্তিসঙ্গত। এভাবে ইব্রাহীম, নহ্ (আ.)সহ সকলেই আল্লাহর সাথে তর্ক করতে পারতেন। কিন্তু তাতে ধ্বংস অনিবার্য ছিল। কারণ স্রষ্টার আনুগত্যেই সৃষ্টির কল্যাণ নিহিত। তাঁর আনুগত্য না করার কারণেই ইবলিস শয়তান তিরস্কৃত ও অভিশপ্ত হয়ে ফেরেশ্তাকূল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিল। আনুগত্যহীনতার পরিণতি এটাই।
নবী-রাসূলগণ (আ.) যেভাবে আল্লাহ্ তায়ালার আনুগত্য করতেন, অন্যদের জন্য এর প্রকৃতি একটু পরিবর্তন করে সহজ করা হয়েছে। যেহেতু অন্যদের কাছে ওহী অবতীর্ণ হয় না, তাই তারা আল্লাহর আনুগত্যের সাথে নবী-রাসূলগণেরও আনুগত্য করবে। আর এই নির্দেশও স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার। ইরশাদ হচ্ছে- “হে নবী! ওদের বলে দিন, তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তারা তোমার আহবান গ্রহণ না করে, তবে (তাদের জানা উচিৎ) আল্লাহ্ কাফিরদেরকে (আল্লাহ্ ও তাঁর বিধান অমান্যকারী) পছন্দ করেন না।” (সূরা ইমরান- ১৩২)।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য অমান্যকারীকে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূরা মুহাম্মদের ৩৩ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্যহীনতার কারণে আমল বাতিল হয়ে যাবে। এভাবে কুরআন মাজীদের অনেক আয়াতে (যেমন- সূরা ইমরান- ১৩২, সূরা আহ্যাব- ৭১, সূরা নিসা- ৮০) আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.)এর আনুগত্য করা মানে কুরআন ও সুন্নাহ্ অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মাঝে আমি দু’টো জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষণ তা আঁকড়ে ধরবে। জিনিস দু’টো হলো, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ্ (আদর্শ)। (মুয়াত্তয়ে মালেক)। সাহাবী ইমরান ইব্নে হুসাইন (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরআন নাযিল হল এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সুন্নাত প্রতিষ্ঠিত করলেন। অতঃপর বল্লেন, তোমরা আমার অনুসরণ কর। আল্লাহর ক্বসম, যদি তা না কর, তবে তোমরা গুমরাহ্ হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমাদ )।
কুরআন ও হাদীসের এসব নির্দেশ থাকার কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সাহাবীগণ নিজেদের জীবন কুরবান করেও আল্লাহর ওয়াস্তে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নির্দেশের আনুগত্য করতেন। যেমন, ওহদের যুদ্ধে তাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) কে রক্ষার্থে তাঁর নির্দেশে তাঁরা জীবন দিয়েছেন। মু’তার যুদ্ধের তিন জন সেনাপতি তাঁদের আগাম শাহাদাত সংবাদ জেনেও রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর নির্দেশের আনুগত্য করতে মৃত্যুর দুয়ার খুলে দিতে যুদ্ধে শরীক হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে অনেক অনেক নিদর্শন বহন করে তাঁরা ইতিহাসকে আমাদের জন্য সাক্ষ্য বানিয়ে অমর হয়ে আছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, “স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।” (মুসনাদে আহমদ)।
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.)এর আনুগত্য করতে হবে নির্দ্বিধায়। আর অন্য যে কোন (পীর-দরবেশ, আলেম, নেতা, মুরুব্বী) ব্যক্তির আনুগত্য হবে শর্ত সাপেক্ষ। অর্থাৎ- আল্লাহ্ ও রাসূল (সা.)এর বিধান মুতাবেক হলেই মানা যাবে। অন্যথায় নয়। হযরত আবুবকর ও উমর (রাযি.) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর অভিষেক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান মুতাবেক হুকুম দেব, কেবল ততক্ষণই আমাকে মানবে।” হযরত উমর (রাযি.) এর এক প্রশ্নের জবাবে তো মজলিশের এক সাধারণ লোক দাঁড়িয়ে বল্লেন- আপনি কুরআন ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলে গেলে এই তরবারী দিয়ে আপনার সাথে ফায়সালা করব এবং হযরত উমর (রাযি.) এ কথা শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।
মূলত এভাবেই তো মু’মিন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.) ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য না করার শপথ নিয়েছে- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর মাধ্যমে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে জীবনের সকল পরিমণ্ডলে তার ও তার হাবীবের যথার্থ অনুকরণ,অনুসরণ ও আনুগত্যের তাওফীক দান করুন। আমীন !!!
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই