অগ্রদৃষ্টি ডেস্কঃ চলমান ইউপি নির্বাচনের ছয় ধাপেরই মনোনয়নপত্র দাখিলের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। দলীয় প্রতীকের এই নির্বাচনে প্রথম ধাপ থেকেই বিএনপির প্রার্থীশূন্যতার হিড়িক পড়ে। এর ধারাবাহিকতা আছে শেষ ধাপেও। ৬ষ্ঠ ধাপের ৭২৪টি ইউপির মধ্যে ৬৯টি ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারেনি বিএনপি। সব মিলিয়ে এবারের ইউপি নির্বাচনে ৫৫৪টি ইউপিতে প্রার্থীহীন বিএনপি। আগামীকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করছেন ইসি কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অস্বাভাবিক এবং তদন্তের বিষয়। প্রার্থীহীনতা ঠেকাতে ইসি’র দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। এর দায় কমিশনের ওপরই পড়ে বলে মত দিয়েছেন তারা।
সারা দেশে ৪,৫৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে এ বছর মেয়াদ শেষ হয়েছে ৪,২৭৫টির। গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ছয়টি ধাপে ভোটগ্রহণের দিন ধার্য করে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া এসব ইউপির তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন জটিলতায় ১৫৩টি ইউপির নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ৬ষ্ঠ ধাপের ৭২৪টি ইউনিয়নসহ সর্বশেষ নির্বাচন হচ্ছে ৪,১২২টি ইউপির। এর মধ্যে ৬ ধাপে সর্বমোট ৫৫৪টি ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারেনি বিএনপি। তার মধ্যে প্রথম ধাপেই ৭১২টি ইউপির মধ্যে বিএনপির প্রার্থী ছিল না ১১৯টিতে। দ্বিতীয় ধাপের ৬৩৯টির মধ্যে ৭৯টি, তৃতীয় ধাপের ৬১৫টির মধ্যে ৮১টি, চতুর্থ ধাপের ৭০৩টির মধ্যে ১০৬টি, পঞ্চম ধাপের ৭২৯টি ইউপির মধ্যে ১০০টি ও শেষ ধাপের ৭২৪টি ইউপির মধ্যে ৬৯টি ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারেনি দলটি। আগামীকাল ষষ্ঠ ধাপের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। প্রত্যাহার শেষ হলে বিএনপির প্রার্থীহীনতা আরো বাড়তে পারে বলে ইসি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসাব বলছে, অতীতে যেসব দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি, তার মধ্যে এবারই প্রথম যে এত বেশি জায়গায় প্রার্থীহীন থাকতে হয়েছে দলটিকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ভয়ভীতি ও প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে এত বেশি ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে পারেনি তারা। এছাড়া, প্রত্যেক ধাপেই দাখিল করার পর প্রত্যাহারের দিন প্রার্থীহীনতা আরো বেড়ে যায়। দলটি এও অভিযোগ করেছে, কোনো কোনো স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও জোরপূর্বক তা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরাসহ দলগতভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হলেও তা কানে নেয়নি নির্বাচন কমিশন। প্রত্যেকবারই নির্লিপ্ত থেকেছে কমিশন। যদিও সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে দাবি করেছেন, নির্বাচন কমিশন মোটেও নির্লিপ্ত ছিল না। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, প্রার্থী না দিতে পারা বিএনপিরই ব্যর্থতা। এর জন্য তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা দায়ী। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি এমন একটি দল, যে দলে প্রত্যেক ইউপিতে চেয়ারম্যান হওয়ার মতো ৫/৬ জন রয়েছেন। সেখানে প্রার্থী না দিতে পারা আমাদের ব্যর্থতা নয়। দেখা গেছে, নমিনেশন পেপার নিয়ে গেছে। কিন্তু দাখিল করতে পারেনি। অথবা দাখিল করেছে, তারপর বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটা নির্বাচনী দস্যুবৃত্তির কারণে হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা যে অচল হয়ে গেছে, তারই প্রমাণ। না হলে বিএনপির মতো একটা দল প্রার্থী দিতে পারবে না, এটা মানা যায় না।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমীন মুরশিদ বলেন, এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। এতগুলো ইউপিতে বিএনপি প্রার্থী দিতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের তো প্রথম ধাপেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত ছিল। এটা অবশ্যই তদন্তের বিষয়। বিএনপি তাদের নিজেদের দুর্বলতার কারণে নাকি অন্য কোনো কৌশলের কারণে প্রার্থী দিতে পারেনি তা খতিয়ে দেখা উচিত।
অবশ্য প্রথম ধাপের এসব অভিযোগের পরে দুই জায়গায় মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা করেছিল নির্বাচন কমিশন। দ্বিতীয় ধাপ থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কেও মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে অনেক প্রার্থী অভিযোগ করেছেন ইসিতে। এরপর শেষের তিন ধাপে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে ইসির পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় এবং চতুর্থ ধাপেও সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি কমিশন। শেষের দুই ধাপে এর ব্যবস্থা হবে বলে জোর আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বয়ং সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেলো ছয় ধাপের মনোনয়ন দাখিলের কার্যক্রম। অনলাইনে মনোনয়ন জমা নেয়া কেবল ইসি’র প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো। এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের হাতে কোনো ম্যাজিকেল পাওয়ার নেই যে সবকিছু তড়িগড়ি ব্যবস্থা করা যাবে। আমরা আমাদের আইটি কর্মকর্তাদের বলেছিলাম। তারা বিষয়টি নিয়ে চেষ্টাও করেছে। কিন্তু পেরে ওঠা হয়নি। ভবিষ্যতের কোনো নির্বাচনে আমরা এই ব্যবস্থা করতে পারবো বলে আশা প্রকাশ করছি। যদিও আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেয়ার ব্যবস্থা করাটা স্বল্প কিছু সময়ের ব্যাপার। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরই আগ্রহের ঘাটতি ছিল।
এদিকে শেষ ধাপেও ৫টি ইউপিতে ক্ষমতাসীন দলের একক প্রার্থী রয়েছে। এর আগের ৫ ধাপে মোট ১৯২টি ইউপিতে ভোটের আগেই জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। আগামীকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষ হলে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।