ধর্মীয় দর্শন ডেস্ক: মৃত্যু আল্লাহর ক্ষমতা প্রমাণকারী এবং তাঁর সৃষ্টির ওপর তাঁর প্রতাপের একটি অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই তাঁর বান্দাদের ওপর আধিপত্যের অধিকারী। তোমাদের কাছে তিনি ফেরেশতাদের পাঠান, এমনকি যখন তোমাদের কারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে আমার দূতরা তার মৃত্যু ঘটায়। আর তারা কোনো অবহেলা করে না।’ (সূরা আনআম)।
মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ন্যায়বিচার। সব সৃষ্টি এখানে সমান। আল্লাহ বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারী। অতঃপর আমার দিকেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে।’ (সূরা আনকাবুত : ৫৭)। মৃত্যু সব স্বাদকে কর্তন করে। দেহের সব স্পন্দন থামিয়ে দেয়। সব দলকে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন করে। চেনাজানাদের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করে। জীবন ও মৃত্যুর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই। আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন।’ (সূরা মোমিনুন : ৮০)।
কোনো প্রহরী, কোনো রক্ষী মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। সম্পদ, সন্তান, সাথী-সঙ্গী কিছুই কাজে আসে না। মৃত্যুর হাত থেকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ কেউ রেহাই পায় না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, যদি তোমরা শক্তিশালী দুর্গেও থাক।’ (সূরা নিসা : ৭৮)। মরণ নির্ধারিত সময়ে হঠাৎ করে এসে পড়বে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কারও মৃত্যুর নির্ধারিত সময় চলে এলে কিছুতেই বিলম্ব করেন না।’ (সূরা মুনাফিকুন : ১১)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার সব স্বাদ-আহ্লাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (তিরমিজি, নাসাঈ)। উবাই ইবনে কাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাতের এক তৃতীয়াংশ চলে গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে বলতেন, হে লোকরা, তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করো। প্রকম্পিতকারী এসে গেছে। পশ্চাতে আসছে পশ্চাদগামী। মৃত্যু সদলবলে এসে গেছে।’ (তিরমিজি)। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মৃত্যু উপদেশদাতা হিসেবে যথেষ্ট, কাল বিচ্ছেদ ঘটাতে যথেষ্ট। আজ ঘরে তো কাল কবরে।’ (ইবনে আসাকির)।
মৃত্যুর প্রস্তুতির ভেতরেই নিহিত আছে প্রকৃত সৌভাগ্য, অপার সুযোগ ও চূড়ান্ত সফলতা।
কেননা মৃত্যু জান্নাতের অথবা জাহান্নামের সর্বপ্রথম ধাপ। মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে হবে সারা জাহানের রব আল্লাহর তাওহীদ বাস্তবায়ন করে। আল্লাহর ইবাদত করে। তার সঙ্গে কাউকে শরিক না করে। সব ধরনের শিরক পরিহার করে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী সমপরিমাণ গোনাহ নিয়েও আমার কাছে এসো আর আমার সঙ্গে কাউকে শরিক না করে থাকো তাহলে আমি সে পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে হাজির হবো।’ (তিরমিজি)।
শরিয়তের বিধিবিধান ও ফরজগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে হবে।কবিরা গোনাহ ও বিভিন্ন পাপ থেকে বিরত থেকে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে হবে । আল্লাহ বলেন, ‘যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে যদি তোমরা সেসব বড় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারো, তবে আমি তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে দেব এবং সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।’ (সূরা নিসা : ৩১)। সৃষ্টজীবের হক আদায় করে, সেগুলোকে নষ্ট না করে অথবা তা নিয়ে গড়িমসি না করে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে হবে। আল্লাহর হক তো শিরক না হলে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে বান্দা ও সৃষ্টির হক তিনি ক্ষমা করবেন না। জালেমের থেকে মজলুমের হক আদায় করেই ছাড়বেন। অসিয়তনামা লিখে রাখতে হবে এবং তাতে সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না।
যে কোনো সময় মৃত্যুর আগমনের জন্য প্রস্তুত থাকা চাই। ‘আল্লাহ যাকে হেদায়েত দিতে চান ইসলামের জন্য তার বক্ষকে উন্মোচন করে দেন।’ সূরা আনআমের ১২৫নং আয়াতটি যখন নাজিল হলো তখন নবী (সা.) বলেন, ‘একটি আলো যা আল্লাহ হৃদয়ে ঢেলে দেন। লোকরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এটার চিহ্ন কী? তিনি বলেন, চিরস্থায়ী ঠিকানার দিকে মনোনিবেশ করা, ধোঁকার দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়া আর মৃত্যু আসার আগে তার জন্য প্রস্তুতি নেয়া।’ কল্যাণের সঙ্গে জীবনাবসান হওয়াই মৃত্যুবরণকারীর জন্য সৌভাগ্য। হাদিসে আছে, ‘আমলগুলো শেষ পরিণতি অনুসারেই বিবেচিত হবে।’
মুআজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেন, ‘যার শেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ সে জান্নাতে যাবে।’ (আবু দাউদ)। মৃত্যুর সময় কাছের লোকরা ধীরেসুস্থে কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে থাকবে যাতে মৃত্যুপথযাত্রী তা স্মরণ করতে পারে, তবে জোরাজুরি করা যাবে না। কেননা সে তো কঠিন পরিস্থিতিতে আছে।’
অতএব, সার্বক্ষণিক দোয়া ও আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে জীবনের কল্যাণময় পরিণতি কামনা করে আমাদের সকলকে এখন থেকেই মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে সেই তাওফীক এনায়েত করুন । আমীন !!!
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই