বিশেষ প্রতিনিধিঃ- পৌরসভার পর দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে প্রতি ইউপিতে রাজনৈতিক দল সর্বোচ্চ ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারবে। এমন বিধান রেখে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে ভেটিং এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বিধিতে বলা হয়- নির্বাচনের উদ্দেশ্য, তদকর্তৃক মনোনীত প্রার্থীগণের নির্বাচনী ব্যয়সহ, প্রার্থীর মনোনয়ন প্রদান সাপেক্ষে প্রতি ইউনিয়নের জন্য ত্রিশ হাজার টাকার অধিক ব্যয় করিতে পারিবে না, কোনো রাজনৈতিক দল দশ হাজার টাকার অধিক পরিমাণের কোনো দান চেক ব্যতীত গ্রহণ করতে পারিবে না।
বিধিতে আরো বলা হয়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল এই বিধির কোন বিধান লংঘন করে, তাহা হইলে উক্ত রাজনৈতিক দল অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
এ ছাড়া বিধির ১২ এর (ইই) বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী বা
তাহাদের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষরিত এই মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র থাকিবে যে, উক্ত প্রার্থীকে উক্ত দল হইতে মনোনয়ন দেওয়া হইয়াছে।
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো রাজনৈতিক দল কোনো ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করিতে পারিবে না, একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করিলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে উক্ত দলের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।
আরও শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল উহার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম, পদবি, নমুনা স্বাক্ষরসহ একটি পত্র তফসিল ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের নিকট এবং উক্ত পত্রের একটি অনুলিপি নির্বাচন কমিশনেও প্রেরণ করিবে।’
বিধিতে আরো বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থীদের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে বিধিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য আলাদা কোনো শর্ত রাখা হয়নি। যদিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক শতাংশ এবং পৌরসভা নির্বাচনে একশ’ জন ভোটারের সমর্থনযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, পৌর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো সমর্থন তালিকা দেওয়ার পক্ষে নয় ইসি। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর পক্ষে সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের পরও তা নিয়ে অস্বীকারের প্রবণতা যেমন দেখা যায়। অনেক সময় প্রার্থিতা বাতিলও হয়। এমন অবস্থায় ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় বিশেষ কোনো শর্তারোপ করা হয়নি।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে কোনো সমর্থনের প্রয়োজন হবে না। পর্যায়ক্রমে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করতে হবে। এতগুলো ইউনিয়ন পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন যাচাই সঠিকভাবে সম্ভব হবে না। তাই শর্তটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিধিতে রাখা হয়নি।’
শাহনেওয়াজ বলেন, ‘নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউপি তফসিল ঘোষণা করা হবে। উল্লেখ্য, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকারের ইউপি নির্বাচন করার বিষয়ে গত নভেম্বরে বিল পাস হয় সংসদে। এতে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ও সদস্যপদে নির্দলীয়ভাবে ভোট হবে।
বিধিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটের আগে সদস্য পদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলে বিদ্যমান নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী বাকি প্রার্থীর মধ্যে ভোটের সুযোগ রয়েছে। তবে চেয়ারম্যান পদে কেউ মারা গেলে নির্বাচন স্থগিত করে পুনঃতফসিল করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া চূড়ান্ত খসড়া বিধিমালায় ইউপি নির্বাচনে দলীয় ৪০টি প্রতীকের বাইরে স্বতন্ত্র পদের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জন্য ১০টি প্রতীক (আটোরিকশা, আনারস, ঘোড়া, টেবিল ফ্যান, ঢোল, টেলিফোন, চশমা, দুটি পাতা, মোটরসাইকেল, রজনীগন্ধা ফুল), সাধারণ সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীদের জন্য ১২টি (আপেল, ক্রিকেট ব্যাট, ঘুড়ি, টিউবওয়েল, পানির পাম্প, ফুটবল, টর্চ লাইট, ভ্যান গাড়ি, বৈদ্যুতিক পাখা, মোরগ, লাটিম ও তালা) এবং নতুন ১০টি প্রতীক (হেলিকপ্টার, ক্যামেরা, বই, কলম, তালগাছ, মাইক, জিরাফ, সাঁকো, বক ও সূর্যমুখী ফুল) রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে ইউপি নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করতে ১৯ জানুয়ারি কমিশন সভার আহবান করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারায় আচরণবিধিমালা চূড়ান্ত করতে সময় নিচ্ছে ইসি। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী প্রচারণায় উপজেলা চেয়ারম্যানরা অংশ নিতে পারবে এমন বিধান রাখার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ১৯ জানুয়ারি কমিশন সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানায় ইসি কর্মকর্তারা।
এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ইসিতে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন উপযোগী ইউনিয়ন পরিষদগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
গত নভেম্বরে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে এবং সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে নির্দলীয় নির্বাচনের বিধান করা হয়। আগামী ৩১ জানুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর হালনাগাদ তালিকা দিয়েই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ২৯ (৩) ধারা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তারিখ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এ হিসাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে সবগুলো ইউপির নির্বাচন শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
দেশে সব মিলিয়ে (১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩ এবং ২০১১) আটবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে।