দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বিবেধ দূর করার লক্ষ্যে এবং মানুষের প্রতি মানুষে সহমর্মিতা এবং মানবতাবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ঘোষিত হয় সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩১৭ তম প্লেনারি সভায় ৪২৩ (ভি) প্রস্তাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে পালিত হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। জাতিসংঘের সকল সদস্যভূক্ত রাষ্ট্র, ঐদিন সভা, আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, র্যালী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দিবসটি পালন করে থাকে। দিবসটি রাষ্ট্রিয় ভাবে পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলিও যথাযথ মার্যাদায় পালন করে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও আজ পালিত হবে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। প্রতি বছরের মত এবারও দিবসটি পালনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির খবর রাষ্ট্রিয়, আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলির বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়।
মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের একধরনের অধিকার, যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ ও চর্চা করবে, তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সঙ্গে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হলো এসব অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণ করা। উইকিপিডিয়া (বাংলা) থেকে উপরে উল্লেখিত মানবাধিকারের সংজ্ঞাগুলি পেয়েছি। ব্যক্তি হিসাবে প্রতিটি মানুষ তার মানব অস্তিত্বের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে মানবাধিকার পাওয়ার যোগ্য। আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে মানবাধিকারের প্রধান বিষয়গুলো দাঁড়ায়, জীবন ধারনের অধিকার, সম্পদের অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, মান-মর্যাদা ও ইজ্জতের অধিকার, আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, যাতায়ত ও স্থানান্তরের অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, বাক স্বাধীনতার অধিকার, নারী ও শিশুর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদি। উপরে বর্ণিত অধিকারগুলোর চর্চা বিশ্বের কোন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। মানব সভ্যতার উৎকর্ষের এ যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম ভাবে লংঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার। বর্তমান সময়ে মানবাধিকার রক্ষায় দেশে দেশে বিভিন্ন নামে মানবাধিকার সংগঠনগুলি সোচ্চার হচ্ছে, তারপরও মানুষের কাছে মানবাধিকার সোনার হরিণ। সাধারণ মানুষ আজ মানবাধিকার ভোগ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে।
মানবাধিকারের ব্যাপারে জাতিসংঘের অভিমত হল, ব্যক্তি যেসকল সুযোগ সুবিধার দাবীদার হয় এবং যেসকল সুযোগ সুবিধা ছাড়া তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়না, সে গুলোই হল মানবাধিকার, বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার বিষয়টি সর্বাধিক আলোচিত ও সমালোচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ তার বেঁচে থাকার নূন্যতম মৌলিক অধিকারগুলো আদায়ের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান ব্যক্তি কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, শাসকের হাতে শোষিত হচ্ছে জনগণ, প্রশাসনের কিছু অসৎ ব্যক্তি কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছে সাধারণ জনগন, শিশু ও নারী নির্যাতন বেড়েছে দেশে দেশে, লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার বেড়েছে ব্যাপক হারে।
জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দেশে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের দিকে নজর দিলেই দেখা যায় মানবাধিকার কতটুকু বিপর্যস্ত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটির সরকার। সরকারী বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, শিশুদের জবাই করছে, নারীদের ধর্ষন করছে, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে। এরফলে রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে নাফ নদীতে ঝাপ দিচ্ছে, তবুও রেহাই পাচ্ছে না। নদী থেকে তুলে এনে হত্যা, জবাই ও ধর্ষন করা হচ্ছে। কেউ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে শরনার্থী হিসাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। মানবাধিকার যে কতটুকু বিপর্যস্ত তা রাখাইন পরিস্থিতিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বিশ্ব বিবেককে।
আমাদের দেশেও মানবাধিকার পুরোপুরি বিপর্যস্ত। আমাদের দেশে মানবাধিকারের অবস্থা জানতে হলে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার দিকে চোখ রাখলেই চলে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গুম, ক্রশফায়ার, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, দখলবাজী, দূর্নীতি, চুরি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজী, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষন, দলীয়করণ, অাত্মীয়করন, লুটপাট, বাক-স্বাধীনতা হরণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি বাংলাদেশের নৈমত্তিক ঘটনা। উল্লেখিত চিত্রগুলোই মানুষের মানবাধিকার ধূলায় মিশিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সহজেই বলা যায়, বাংলাদেশে দৈনিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে চরমভাবে। দেশের মানবিধাকার প্রশ্নে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বারবার হতাশা ব্যক্ত করেছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ সহ দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখা উচিৎ, মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। নাগরিক জীবনের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য মানবাধিকারের প্রয়োজনীয়তাকে কেই অস্বীকার করতে পারেনা, পারবেনা। তাই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের সকল নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে এবং দেশের সরকারকেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে সেখানে জোর প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। মানবাধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। মানবাধিকার কর্মীদের মানবাধিকার রক্ষায় কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। দেশে একদিন মানবাধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হবে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখকঃ মানবাধিকার কর্মী ও কলামিস্ট।