ইঞ্জিনিয়ার আরিফ চৌধুরী শুভ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর অর্পিত ভ্যাট প্রত্যাহারের খবর শুনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের উৎসব শুরু হল রাজপথে। হঠাৎ করে চৈত্রমাসে বৃষ্টির মত শিক্ষার্থীরা ভীড় জমাল মিষ্টি দোকানে। মিষ্টি দোকানিরা আগ থেকে যদি কোন পূর্বাভাস পেত তাহলে শিক্ষার মত মিষ্টির উপর ও একটা ভ্যাট বসানোর চিন্তা করতেন নিশ্চয়। গরম গরম মিষ্টি আর গ্রীশ্মের প্রখর রোদ কোন কিছুই যেন তৃপ্তির বাহিরে না। এ যেন এক নতুন বিজয়। ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, ফেরিওয়ালা, গাড়ির ড্রাইভার থেকে হেলপার পর্যন্ত বাদ যায়নি কেউ মিষ্টি খাওয়া থেকে। রাস্তায় এক মুড়ি বিক্রেতাকে দেখলাম পকেট থেকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন নেন মামা আমার টাকাটাও যোগ করে মিষ্টি আনেন। সবাই এক সাথে খাব। এত ক্ষোভ, হতাশা আর অধিকার আদায়ে মুখরিত রাজপথ হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল মিষ্টির তৃপ্তিতে। রাস্তার একপাশে উল্লাসে বাঁধ ভাঙ্গা শিক্ষার্থীদের আনন্দে ঘাম আর অশ্রু এক হয়ে গেল দেখে এই স্বাদ আমি মনে মনে ভোগ করেছি।
১৪ তারিখ বিকালে সেস্ট ইউনিভার্সিটিতে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশান’ সাংবাদিকদের কনফারেন্স শেষে এক সাংবাদিক ভাই আমাকে বলল আপনিতো মিষ্টি খান নাই আমি দেখছি। চলেন একটা মিষ্টি আমার পক্ষ থেকে আপনি খাবেন। আমি বললাম বিজয়ের স্বাদ তৃপ্তিতে, মিষ্টিতে নয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন তিনি। মনে হচ্ছে এই মাত্র ভেতরের সব কষ্ট দূর হয়ে গেল তার। সাথে সাথে আমারও। ভ্যাট মুক্ত শিক্ষার দাবি আসলে সবারই ছিল।
শরীরের লাল পাঞ্জবীটা ঘামে একবার ভিজে একবার শুকায়। চুনাকার ঘামের দাগগুলো রাতের পর থেকে আর নেই। কারণ আমি সারফেক্সেল দিয়ে ধুয়ে দিলাম একমাত্র পাঞ্জাবিটা। অনেকে এখন দেখা করতে আসে আমার মেসের গলিতে। রুমের পরিবেশ ভালো না বলে কেউ আসতে চাইলেই নানা কারণ দেখাই। তাই তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবিটা পরিষ্কার করেছি। কখন যে আবার বের হতে হয় ঠিক নাই। তবে আপাতত কয়েক দিন যে বের হতে হবে না সেটা আমার রুমমেটে সুমন মজুমদার নিশ্চিত করেছেন। ভার্সিটি ছোট ভাইরা বলেছে ভাই অনেক কষ্ট করেছেন এবার কয়েক দিন রেস্ট নেন। সবাই রোদে পুড়ে আন্দোলন করছি আমি কেন আলাদ বিশ্রাম নেব? বিবেকের কাছে এমন প্রশ্ন আসলেও অতিরিক্ত ঘাম বের হবার কারণে শরীরটা আমাকে রেস্ট না দিয়ে ছাড়ছে না। শুয়ে শুয়ে ভাবছি মিষ্টির বিজয়ের স্বাদ তৃপ্তিতে না মিষ্টিতে?
৬২ এর ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে নানা বৈষম্য আর শিক্ষাকে সার্বজনীন করার দাবিতে। ২০১৫ সালে এসে দীর্ঘ ৫৩ বছর পর আরেক বৈষম্য ছাত্র সমাজ মানতে নারাজ। একই বাবা মায়ের সন্তানে যেমন রক্তের ভেদাভেদ হয় না তেমনি একই বাবার সন্তান হয়ে সরকারের দুই রকম নীতির বিরেুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। অর্জিত হয়েছে দীর্ঘ ৩ মাস আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ত বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ। তাই রাজপথে সংরামের অর্জন উপভোগ করতে মিষ্টি কেনার টাকায় ফেরিওয়ালার টাকাও যোগ হয়েছে। কারণ আমরা যে অনেকেই ফেরিওয়ালার সন্তান। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে ফেরিওয়ালাদের দাবির কোন মূল্য নাই। নয়তো একটি মৌলিক দাবির পক্ষে দীর্ঘ তিন মাস রাজপথে থাকতে হতো না। ফেরিওয়ালাদের কাছে ফেরিওয়ালাদের মূল্য আছে। কোন মন্ত্রী বা এমপি বলেনেনি আমার পকেটের টাকাটা তোমার মিষ্টি কেনার টাকার সাথে যোগ কর। ফেরিওয়ালাদের সন্তানের দাবির সাথে, আনন্দের সাথে ফেরিওয়ালারাই আওয়াজ তুলেছে মিষ্টি মুখ করেছে।
ভবিষ্যতের ফেরিওয়ালারা নিশ্চয় আমাদের মত সন্তান জন্ম দেবেন না। তাদের ধৈয্য আর প্রখরাতা হবে আলোর গতির মত। কোন অন্যায় দেখলে পরিবেশ তৈরির কথা চিন্তা না করে নিজেরাই নেমে পড়বে প্রতিবাদে। যে ভাই বোনেরা নিজেদের দাবির পক্ষে রাস্তায় নামতে দেরি করেছেন তাদের জন্য এ বিজয় আসতে হয়তো তিনমাস লেগেছে। নয়তো ছাত্র ধর্মঘটের মত কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই আমরা সফল হতাম। অরাজনৈতিক পরিবেশে নিজেদের একতা আর ধৈয্যকে যদি সঙ্গবদ্ধ রাখা না যায় তাহলে তুচ্ছ দাবি আদায়েও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। তাই এখনই উপযুক্ত সময় নিজেদের মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগ আর সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। সম্পুন্ন ভিন্ন একটি চরিত্র জাতি বেসরকারি শিক্ষার্থীদের কাছে উপহার পেয়েছে। এই আদর্শ বর্তমান, ভবিষ্যতেও ধরে রাখতে হবে। বিসিএস এর মত জায়গায় যখন প্রথম হওয়ার গৌরব আমাদের আছে, তখন অহিংস মনোভাবে নিজেদের সফলতা বাড়াতে হবে।
সব কচু পাতায় যেমন বৃষ্টির পানি জমে না তেমনি নিজেকে ছাত্র দাবি করতে হলে কচুপাতার পানির মত নিজের মধ্যে ছাত্রত্বের গুনাবলি জন্মাতে হবে। জন্মাতে হবে সংকটাপন্ন পথ থেকে বের হবার সঠিক পথ। একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের কথায় পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠতে হবে। বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখুন আপনারা কি আজ সেই পথে আছেন? সত্যিকারের নেতাকে আপনারা কি খঁজে বের করতে পারবেন?
দেয়ালের রশিতে লাল পাঞ্জাবিটা ঝুলে আছে চোখের সামনে। কত দাগ কত ঘাম আর তপ্তরোদে পোড়া পাঞ্জাবিটা কতদিন আরও এভাবে পুড়বে জানি না। তবে নিজের ভেতর নিজেই পুড়ে যাচ্ছি এখনও। বিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ি হচ্ছে না। কারণ সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি না মেঘ দেখিয়ে বৃষ্টির আশায় শ্রাবণ পার। সংগ্রামী সহপাঠিদের কণ্ঠগুলো গেঁথে আছে হৃদয়ে। সরকারের প্রতিশ্রুতিও গেঁথেছি একই ভাবে। পাল্টালে সবই পাল্টাবে। তবুও শেষ বেলায় আমরা সফল। কলঙ্কমুক্ত শিক্ষার বিজয় উল্লাসের স্বাদ তৃপ্তিতে, মিষ্টিতে নয় ।