মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানঃ আমি আজকে এই বিষয়ে যা বলছি তা দায়িত্ব নিয়ে বলছি। আমার স্মৃতি বিভ্রম যদি নাহয়ে থাকে তবে যা বলছি সব সত্য ঘটনা। উনিশ শত চুরাশি সাল আমি তখন সিলেট স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিক্সে ( এস আই এন্ড টি ) ওয়েপন উইং এর চীফ ইনেস্ট্রাক্টর ( সি আই )। তখন এস আই এন্ড টি’র কমান্ডান্ট ছিলেন ব্রগেডিয়ার মোহাম্মদ গোলাম রাব্বাণী ( এম জি রাব্বাণী নামে সমাধিক পরিচিত ) ( ব্রগেডিয়ার পদে অবসর প্রাপ্ত এবং জীবিত )। খবর এলো জেনারেল এম এ জি ওসমানী ষোলোই ফেব্রুয়ারি উনিশ শত চুরাশি লন্ডনে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর মরদেহ আসছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে। এস আই এন্ড টি কমাডান্ট ব্রিগেডিয়ার এম জি রাব্বাণী আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে জেনারেল ওসমানীর কফিন গ্রহন, গার্ড অব অনার প্রদান , গান ক্যারেজে করে তাঁর মরদেহ শোভাযাত্রা সহকারে হযরত শাহজালাল ( র: ) এর মাজার প্রাঙ্গণে আনয়োন এবং তাঁর কবর প্রস্তুত করন এবং জানাজা শেষে তাঁকে দাফন এবং দাফন শেষে গান স্যালুট প্রদানের যাবতীয় দায়িত্ব আমার উপরে অর্পণ করলেন। কুমিল্লা ডিভিশন থেকে গান ক্যারেজ এলো। গার্ড অফ অনার প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সৈনিক এবং সরঞ্জাম সব প্রস্তুত হলো এডমিন ব্যাটালিয়ান থেকে। আমি যথা সময়ে বঙ্গবীর মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর কফিন ওসমানী বিমানবন্দরে এস আই এন্ড টি কমাডান্টের পক্ষে গ্রহন করলাম। বিমানবন্দরে গার্ড অফ অনার প্রদান শেষে তাঁর কফিন গান ক্যারেজে করে শোভাযাত্রা সহকারে হযরত শাহজালাল ( র: ) এর মাজারে এনে প্রথমে জানাজা সম্পন্ন করে তাঁকে হযরত শাহজালাল ( র: ) এর মাজারস্হ কবরস্থানে দাফন করা হলো। পরে গান সেল্যুট এবং লাষ্টপোষ্ট বিউগলে ধ্বনিত করে আমরা তাঁকে শেষ বিদায় জানালাম। সমস্ত অনুষ্ঠান খুব নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো আমার একক নেতৃত্বে সবার সহযোগীতায়। এটা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।
এলো উনিশ শত পঁচাশি সাল। তারিখ ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। তখন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায়। কমান্ডান্ট ব্রগেডিয়ার এম জি রাব্বাণী আমাকে ডেকে বললেন যে সিলেট শহরে জেনারেল ওসমানীর বাড়ীতে ট্রাষ্টি বোর্ডের একটি মিটিং হচ্ছে তুমি সেখানে আমাকে রিপ্রজেন্ট করো । তখন বেলা প্রায় এগারোটা হবে। আমি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর বাড়ীর উদ্দেশ্য জীপে করে রাওয়ানা করলাম। ওখানে পৌছে দেখলাম মিটিং প্রায় শেষের দিকে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসি উদ্দীন ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন সাথে অন্য একজন যার নাম মনে পড়ছেনা। তবে জেনারেল ওসমানীর একজন আপন ভাগ্নেকে সেখানে উপস্থিত দেখতে পেলাম। আমি জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দীনকে স্যালুট করে বিনয়ের সাথে জানালাম কেন আমার আসতে দেরী হয়েছে? এবং বললাম আমি এস আই এন্ড টি কমাডান্টকে এই মিটিং এ রিপ্রেজেন্ট করছি। জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং টানা টানা বাংলা উচ্চারণে আমাকে একটি রানডাউন দিলেন মিটিং এ কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে আমি আসার আগে। তাঁর কথায় যা জানতে পারলাম তাহলো এই রুপ :
এক। জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মৃত্যুর পরে তাঁর বাসাতে তাঁর বোন চারদিনের মতো ছিলেন। সেই বাবদে যে খরচ হয়েছে তা মিটানোর জন্য জেনারেল ওসমানীর ব্যবহৃত চারটি হাতলওয়ালা চেয়ার সিলেট শহরের একটি সেলুনে বিক্রি করা হয়েছে।
দুই। জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ভাগ্নেকে জেনারেল ওসমানীর ব্যাবহৃত একটি পিস্তল তাঁর ওসিয়ত অনুযায়ী তাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিন। জেনারেল ওসমানীর ব্যবহৃত দোনলা বন্দুকটি তাঁর এক আত্মীয়কে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন জানালেন।
জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন আরো জানালেন এখনও যেসব অনুষ্ঠান করতে হবে তার খরচ মেটাতে জেনারেল ওসমানীর ব্যাবহৃত আরো কিছু জিনিস পত্র বিক্রয় করতে হতে পারে। কথা শেষ করে জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন আমার দিকে ফিরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন কর্নেল সাহেব আপনি কি বলেন? ঐসময় আমার পদবী ছিলো লে: কর্ণেল। লে: কর্ণেলকে সম্বোধনের সময় কর্ণেল বলে ডাকা হয়। আমাকেও তিনি কর্ণেল বলে সম্বোধন করলেন। আমি অতীব বিনয় এবং দৃঢ়তার সাথে বললাম স্যার আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাংলাদেশ হন তবে জেনারেল ওসমানী বাংলাদেশের মাটি। দেশের এই মাটিকে তিনি স্বাধীন করেছেন । আজ জেনারেল ওসমানী দেশের এবং জাতির সম্পদ। তাঁর ব্যাবহৃত সব কিছু দেশের এবং জাতির সম্পদ। আমরা কেউ জেনারেল ওসমানীর কোনো কিছুই কাউকে দিতে পারিনা। আমার কথা শুনে জেনারেল ওসমানী সাহেবের ভাগ্নে আমাকে বললেন আমার মামা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর ব্যাবহৃত পিস্তলটি আমাকে দেওয়ার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন তার কি হবে? উওরে আমি বললাম জেনারেল ওসমানীর ইন্তেকালের পরে তিনি এখন জাতির সম্পদ। জেনারেল ওসমানী একজন সাধারণ মানুষ হলে এই প্রশ্ন উঠতোনা। এই মাটিকে যিনি স্বাধীন করেছেন তাঁর ব্যাবহৃত সবকিছুই এখন জাতির ইতিহাসের অংশ। আমরা যদি ভূল করি তবে ইতিহাস আমাদেরকে ক্ষমা করবেনা। আমি জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললাম স্যার জেনারেল ওসমানীর ব্যাবহৃত চেয়ার সেলুনে বিক্রয় করা হয়েছে। এটাতো স্যার গ্রহনযোগ্য নয়। তিনি নিজে যে চেয়ারে বসেছেন সেই চেয়ারে বসে সাধারণ সব শ্রেণীর মানুষ চুল কাটছে ইজ ইট এক্সেপ্টেবল? আমি জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে অনুরোধ করলাম স্যার সেলুন থেকে ঐ চেয়ারগুলো এখনি নিয়ে আসা হোক। দেরী হলে হয়তো চেয়ারগুলো নাও পাওয়া যেতে পারে। আমি প্রস্তাব দিলাম জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে তিনি যেন প্রেসিডেন্টকে বলে জেনারেল ওসমানীর বাড়ীকে একটি যাদুঘরে রুপান্তরিত করেন যেখানে জেনারেল ওসমানীর ব্যাবহৃত সবকিছু স্বযত্নে সংরক্ষণ করা যায়। আমার কথা শেষ হলে জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন আমাকে বললেন কর্ণেল সাহেব আপনি আমাকে একটা হিস্টরিক্যাল মিসটেক করা থেকে রক্ষা করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন চেয়ারগুলো সেলুন থেকে অতি সত্তর নিয়ে আসতে। এবং এও বললেন জেনারেল ওসমানীর এই বাড়ীকে যাদুঘর করার যা করণীয় তিনি তা করবেন। পরে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীর সিলেট শহরস্হ বাড়ীটি একটি যাদুঘরের রুপ পায়। আমি আমার এই লেখায় যা সত্য তাই লিপিবদ্ধ করলাম।
মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান। (প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর)