জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা : দখল দূষণে বিলুপ্তির পথে রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার রোয়াজারহাট থেকে গুমাই বিল পর্যন্ত বিস্তৃত একসময়কার ¯্রােতশীনি কুলকুরমাই খাল। প্রসস্ত খালটি অপরিকল্পিত স্লুইচ গেট, বর্তমানে দখল ও বর্জ্যরে আবর্জনার স্তুপে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্ষণের অতিরিক্ত পানি অপসারিত হতে না পেরে বাজারের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণকে। তাই জনস্বার্থে খালটিতে দখল ও দূষণ মুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবী করছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক হওয়ার পূর্বে ইছামতি নদীর শাখা কুলকুরমাই খালটি রোয়াজারহাটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। এই খাল দিয়েই কুলকুরমাইসহ উত্তর ও পূর্ব রাঙ্গুনিয়ার মানুষ তাদের কৃষিজ পণ্য বাজারে আনা নেওয়া করতো। মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি বিজড়ীত এই খালটি একসময় এতদ অঞ্চলের মানুষের মাছের চাহিদাও পূরণ করতো। এছাড়াও শস্য ভান্ডার খ্যাত গুমাই বিল ও এর আশপামের কৃষকের সেচের পানির চাহিদা পূরণ করতো এই খালটি। বর্ষণের বাড়তি পানি অপসারিত করে এই খালটি দীর্ঘকাল ধরে অবদান রেখে চলেছিল। কিন্তু বর্তমানে খালটির বেহাল অবস্থা। একদিকে দখলের মহাউৎসব অন্যদিকে বাজারের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই খালে। তার উপর অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত স্লইচ গেট। এছাড়াও খালটির দুই পাড়ের বাড়িঘর ও অবৈধ দখল করে গড়ে ওঠা দোকানের বাথরুমের বর্জ্য নল দিয়ে এই নদীতেই ফেলা হয়। এতে পানি দূষিত হয়ে কালচে রূপ ধারণ করেছে। এলাকার মৎস্য চাহিদা পূরণ করা খালটি মৃত্যু পথযাত্রী প্রায়। স্থানীয়রা জানায়, রোয়াজারহাটের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কুলকুরমাই খালটি পূর্বে ৫০-৬০ ফুট প্রসস্ত ছিল। এটি ইছামতী থেকে শুরু হয়ে রোয়াজারহাট, মোরাদনগর, সৈয়দবাড়ি হয়ে পূর্বে গোমাই বিলে গিয়ে মিশেছে। কাপ্তাই সড়ক হওয়ার পুর্বে এই খালটি এতদ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। এছাড়াও এলাকার কৃষি ক্ষেতে সেচের পানির চাহিদা পূরণসহ বর্ষনের বাড়তি পানি অপসারণ করে এলাকার মানুষকে জলবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতো এই খালটি। ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অনেক নীরিহ বাঙ্গালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে এই খাল দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাই মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের অনেক স্মৃতি বিজরীত এই খালটি। কাপ্তাই সড়কের রোয়াজারহাট এলাকায় ১৯৮০-৮১ সালের দিকে ইছামতির উপর স্লুইচ গেট ও ব্রিজ নির্মাণের পর থেকে দখলের পায়তারা শুরু হতে থাকে। বাজারটির পশ্চিম দিকের দোকানপাট ও বাজার পূর্বদিকে চাপতে শুরু করে। শুরু হয় কুলকুরমাই খালের উপর অত্যাচার। দোকান নির্মাণে প্রথমে খালটির উপর কুঠি গেড়ে কোন বাঁধা না পেয়ে আরসিসি কলাম দিয়ে নির্মাণ হতে থাকে দোকান। এভাবে বর্তমানে শুধু রোয়াজারহাট এলাকাতেই অর্ধশতাধিক দোকান নির্মিত হয়েছে এই খালের উপর খুটি গেড়ে। একই কায়দায় মোরাদনগর ও সৈয়দবাড়ি এলাকাতেও খালটি দখল করে নির্মিত হয় বিভিন্ন দোকান, ঘর ও নানা স্থাপনা। ফলে দিন দিন সংকুচিত হয়ে খালটি বর্তমানে ৮-১০ ফুট প্রসস্ত নালায় পরিণত হয়েছে। খাল দখল করে নির্মিত স্থাপনার বাথরুমের বর্জ্য, নানা আবর্জনা এই খালের উপরই ফেলে খালটিকে মৃতপ্রায় করে তোলেছে। বর্তমানে খালটিতে জোয়ারভাটাও হয়না। সৈয়দবাড়ি ও ইছামতি এলাকার মোহন্দর খালের কিছু পানি ঢুকে এই মৃতপ্রায় খালটিতে প্রকৃতপক্ষে এর অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রেখেছে। এদিকে খালের উপর ফেলা নানা আবর্জনায় খাল ভরাটসহ বিষিয়ে তোলেছে এলাকার পরিবেশ। পানি প্রবাহিত হতে না পেরে বর্ষনের সময় খালের পানি উপচে পড়ে প্লাবিত করে রোয়াজারহাট বাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণকে। তাই জনস্বার্থে এটি দখল ও দূষণমুক্ত করা জরুরী বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় রাজনীতিবীদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ‘ছোটবেলায় খালটি এলাকার মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতে দেখতাম। খালটি গুমাই বিলসহ আশপাশের কৃষিজমির সেচের পানি, এলাকার মানুষের মাছের চাহিদা মেটাতো। সর্বোপরী বর্ষনের অতিরিক্ত পানির অপসারণ করে জলমগ্নতার হাত থেকে রক্ষা করতো খালটি। কিন্তু দখলের হিড়িকে হারিয়ে যেতে বসেছে খালটি। তাই এটি উদ্ধার করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা জরুরী।’
স্থানীয় সাবেক পৌরমেয়র খলিলুর রহমান চৌধুরীর পুত্র আরিফুল ইসলাম চৌধুরী জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিতে সংস্কার কাজের অভাব, খালের উপর অপরিকল্পিত স্লুইচ গেট নির্মাণ, দখলসহ বিভিন্ন কারণে খালটি মরতে বসেছে। এটি রক্ষার্তে খননসহ সংস্কার কাজে আমার বাবা সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপির সুপারিশ সম্বলিত আবেদন পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবর প্রেরণ করেছেন। কিন্তু তারা আজ কাল করে এখনও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তিনিও এটি রক্ষার্থে কর্তৃপক্ষের জোর পদক্ষেপ দাবী করেছেন।
মোরাদনগরের প্রবীন ব্যক্তি মনির আহমেদ মেম্বার জানান, খালটি রোয়াজারহাট, মোরাদনগর, সৈয়দবাড়ি সহ গুমাইবিলের কৃষকদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এটির পানিতে সেচের চাহিদা পূরণ করে এতদ অঞ্চলের মানুষ। এটিই কাপ্তাই সড়ক হওয়ার পূর্বে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। এই খালকে ঘিরে মুক্তিযোদ্ধের অনেক স্মৃতি রয়েছে। এটি জোয়ার-ভাটা সম্পন্ন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ খাল ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখিয়ালিপনা ও স্থানীয়দের দখল দূষণে এটি হারাতে বসেছে। তিনিও এই খালের সংস্কার দাবী করেন।
রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার মেয়র শাহজাজহান সিকদার জানান, এই খালসহ পৌরসভার বিভিন্ন দখল দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে। আশাকরি জনসাধারণের দাবী খুব শীঘ্র্ই পূরণ হবে।
ছবির ক্যাপশন : দখল দূষণে বিপর্যস্ত রাঙ্গুনিয়ার কুলকুরমাই খালের বর্তমান বেহাল অবস্থার চিত্র।