নিজস্ব প্রতিবেধকঃ- জাতীয় পার্টিতে (জাপা) গৃহবিবাদে থামছেই না। দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় শীর্ষস্থানীয় নেতারা একেকজন একেক রকম মন্তব্য করছেন। আর তাই প্রতিদিনই নতুন নতুন খবরের জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক দলটি। গত শনিবার সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্লামেন্টারি পার্টি এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য সভার আলোচনা ছাড়াই দলের কো-চেয়ারম্যান অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদসহ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে যে পরিবর্তন এনেছেন সেটাকে দলের নীতিবহিভর্‚ত ও অগণতান্ত্রিক।
তিনি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহŸান জানান। একদিন পরই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল রবিবার রওশন এরশাদের দাবি নাকচ করে দেন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে মনোনীত করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তবে দলের স্বার্থে রওশনকে দরকার জানিয়ে ওই সিদ্ধান্ত (জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান) মেনে নিতে সংসদীয় নেতা রওশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রবিবার দুপুরে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে একথা জানান এরশাদ। এর আগে বিবৃতির বিষয়টি চিঠি আকারে রওশনের কাছে পাঠান তিনি।
অন্যদিকে জাপার নতুন কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে একমত হয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এমনটাই জানিয়েছেন তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক সময় চাওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদে থাকা পার্টির নেতাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদ থেকে ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবো। আলোচনা করেই এসব পদ থেকে সরতে চাই। এ ব্যাপারে পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তারাও একমত। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বনানীস্থ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টি আয়োজিত পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জি এম কাদের এসব কথা বলেন।
জানা যায়, জাতীয় পার্টিতে নেয়া নতুন কিছু সিদ্ধান্তে কয়েক দিন ধরে এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশনের মধ্যে চলছে বিরোধ। এ নিয়ে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে জাপায় দুটি বলয় তৈরি হয়। সে বলয় এখন প্রকাশ্য দুই শিবিরে বিভক্ত। দুপক্ষের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি আহŸান, চাওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। এর মধ্যে গতকাল রবিবার রওশনকে চিঠি পাঠিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিলেন এইচ এম এরশাদ।
চিঠিতে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই বলে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তার স্ত্রী ও দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদকে জানিয়েছেন। শনিবার রওশনের দেয়া বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার এই চিঠি দিলেন এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভ রায় স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ বিষয়টি তিনি রওশন এরশাদকে পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। গত রবিবার রংপুরে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ। পরের দিন (সোমবার) গুলশানে এক বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয় একটি অংশ। এর পরদিন (মঙ্গলবার) এরশাদ জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব পদ থেকে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে অব্যাহতি দিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে আবার দলের নতুন মহাসচিব ঘোষণা দেন।
রওশনের সেই আহŸান প্রত্যাখ্যান করে চিঠিতে এরশাদ তার স্ত্রীকে ‘প্রিয় সহকর্মী’ সম্বোধন করে লিখেছেন, ‘আপনি পার্টির একজন শীর্ষ নেতা এবং সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে পার্টির চেয়ারম্যানের কাছে কোনো বিষয়ে আবেদন, নিবেদন কিংবা বিবেচনার আহŸান জানাতেই পারেন। সেটা আপনার সাংগঠনিক অধিকার। তবে পার্টির স্বার্থে বিবৃতিতে উল্লিখিত আপনার প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আশাকরি আপনিও পার্টির সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করবেন।’ রওশনকে আশ্বস্ত করে এরশাদ লিখেছেন, ‘আপনি সংসদীয় দলের নেতৃত্বে আছেন, আমি পার্টির নেতৃত্বে আছি। আমাদের উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় পার্টি আগামী দিনে এগিয়ে যাবে।’ চিঠিতে নিজের নেয়া দুটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন এরশাদ। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান করার ব্যাপারে আপনারও সম্মতি ছিল।’
নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে এরশাদ আরো লিখেছেন, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির কোনো গঠনতান্ত্রিক পদ নয়। পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে সংগঠনের প্রয়োজনে তিনি কোনো পদ সৃষ্টি বা কাউকে কোনো বিশেষ দায়িত্ব দিতে পারেন। তিনি গঠনতন্ত্রের বহিভর্‚ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারা বলেই এই সিদ্ধান্ত। মহাসচিব পদে রদবদল প্রসঙ্গে এরশাদ রওশনকে লিখেছেন, ‘জিয়াউদ্দিন বাবলুকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। তিনি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে মিডিয়ার কাছে আপনাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। এটা ছিল দলকে বিভক্ত করার একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। সে কারণে, বাবলুকে যে ধারা মতে মহাসচিব করা হয়েছিল সেই ৩৯ ধারাতেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’
এরশাদ আরো বলেন, ‘আপনি আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে অবগত আছেন যে, সংসদীয় কমিটি দলীয় নীতি-নির্ধারণের কোনো শাখা নয়। একমাত্র প্রেসিডিয়ামেরই পার্টির নীতি-নির্ধারণের এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অনুমোদনের এখতিয়ার রয়েছে। সুতরাং দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রেসিডিয়াম বাদে অন্য কোনো শাখার মতামত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নেই।’
অন্যদিকে জাপার নতুন কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে শক্তি। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে আমাকে কাজ করতে হবে। নেতৃত্বের প্রতি আমার কোনো লোভ-লালসা নেই। দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতিতে এসেছি, নেতৃত্বে এসেছি। এরশাদ সাহেব আমাকে যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব আমি জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাবো।’ জি এম কাদের বলেন, ‘এরশাদ সাহেবের এক সিদ্ধান্তের কারণেই আজ জাতীয় পার্টিতে আবার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশের মানুষের মধ্যে এখন জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মানুষ আলোর পথ দেখছে। দুই দলের বাইরে মানুষ এখন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করছে।’ দলের সব নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহŸান জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘আমাদের নিজেদের মধ্যে যদি কোনো দ্বিধাদ্ব›দ্ব থাকে, সেটি দেশের মানুষের স্বার্থে ভুলে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের সবাইকে অতীত ভুলে গিয়ে সামনে গিয়ে যেতে হবে। পার্টির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে দলের মধ্যে আর যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি কেউ চেষ্টা করে, তার বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘পল্লীবন্ধু আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, আমি তা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। দলকে সুসংগঠিত করতে তৃণমূল থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। দলের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোহেল রানা, যুগ্ম-মহাসচিব দেওয়ান আলী, গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টির আহŸায়ক আলহাজ সাত্তার মিয়া, সদস্য সচিব জয়নাল আবেদিন প্রমুখ।
এরশাদের সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বললেন রওশন :
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্লামেন্টারি পার্টি এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য সভার আলোচনা ছাড়াই দলের কো-চেয়ারম্যান অর্থাৎ ভবিষ্যৎ পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদসহ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে যে পরিবর্তন এনেছেন সেটাকে দলের নীতি বহিভর্‚ত ও অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেছেন রওশন এরশাদ। গত শনিবার সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে একথা বলেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিয়ে যে ‘অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির’ সৃষ্টি হয়েছে এরই প্রেক্ষিতে একথা বলেন তিনি। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, জাতীয় পার্টি রাজনৈতিকভাবে সু-প্রতিষ্ঠিত একটি দল। এ পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদল হিসেবে সোচ্চার ও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে চলছে। এমন একটি সু-প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সভা ছাড়াই কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব নির্বাচন অগণতান্ত্রিক।
একই সঙ্গে তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়ে পার্টিতে ও জনমনে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে সেটি সঠিক নয়, কারণ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়ে যৌথসভায় এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি আরো বলেন, জাতীয় পার্টি একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও দেশের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে যাচ্ছে।
বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির মতো পুরাতন দলের বৃহত্তর ঐক্য বজায় রাখার লক্ষ্যে দলের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে নেতৃত্ব পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করার ক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কাজ করবেন বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
বিরোধীদলীয় নেতা আশা প্রকাশ করেন, জাতীয় পার্টির বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এবং দলকে ভবিষ্যতে আরো সুসংগঠিত ও সুসংহত করার লক্ষ্যে পার্টির চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা পুনর্বিবেচনা করবেন।