ডেক্স রিপোর্টঃ- ২০১৫ সালে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসেছে অনেক অর্জন ও চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের ফাঁসির রায় কার্যকর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ও স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী এ বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা।
বিশ্বে প্রভাবশালী শেখ হাসিনা
এ বছর ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরেন পলিসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একশ বিশিষ্ট দৃঢ় চিন্তার ব্যক্তিত্বের তালিকায় জায়গা দিয়েছে। এ বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচনার সৃষ্টি করে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার অবস্থান ১৩ নম্বরে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও এ তালিকায় রয়েছে। জাতিসংঘ সম্মেলনে পরিবেশবিষযক সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরুস্কার চাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ ও বাংলাদেশে আইসিটি প্রসারে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার লাভ করেন। তার আগে নারী-পরুষ বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য তিনি ডব্লিউআইপি( ওম্যান ইন পার্লামেন্ট) গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
যুদ্ধাপরাধের ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের উষ্মা
যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ বিএনপি নেতা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর জাতিসংঘ নেতিবাচক বিবৃতি দেয়। যা প্রত্যাখান করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে এ ফাঁসি কার্যকরে পাকিস্তান উষ্মা প্রকাশ করার পাশাপাশি অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ ঘটনায় পাকিস্তানকে বাংলাদেশ এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করে। এ বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এতে দুই দেশের কূটনীতিক সম্পর্কের অবনতি হয়।
মোদি এলেন বাংলাদেশে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন। তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফুল দিয়ে মোদিকে বরণ করা হয়। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। মোদির সফরকালে স্থল সীমান্ত চুক্তির (এলবিএ) অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তরসহ ২২টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও সম্মতিপত্র সই হয়। ঢাকা ছাড়ার আগে এক টুইট বার্তায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ। এ সফর আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে। এ সফর ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব সুদৃঢ় করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমরা অতীতের অমীমাংসিত বিষয় সাফল্যের সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছি। এটি আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করবে।’
নতুন মানচিত্র
২০১৫ সালে ৩১ জুলাই স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যামে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয়। এর ফলে দুই দেশের মানচিত্র পরির্বতন হয়ে যায়। এ সীমান্ত চুক্তি প্রায় ৪২ বছর পর ভারতের দুই সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। মোদির ব্যক্তিত্বের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছিট মহলের ১১১টি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ১৭ হাজার একর জমি পেয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে নতুন মানচিত্র প্রণয়ন করতে দুই দেশ এগারশ‘র বেশি স্ট্রিপ ম্যাপ প্রস্তুত ও বিনিময় করে। এ ম্যাপগুলোতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের হাইকমিশনার। এর ফলেই নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ-ভারত।
রেডএলার্ট
দুই বিদেশি হত্যাকে কেন্দ্র করে ঢাকার বেশ কয়েকটি দূতাবাস নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। এ সর্তকতা জারির ফলে দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। এ সর্তকতা জারিতে এগিয়ে ছিল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। তাদের রেড এলার্ট জারিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিরক্তি প্রকাশ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়- এর চেয়ে খারাপ অবস্থা অনেক সময় তাদের দেশে বিরাজ করেছে। এর প্রভাবে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিম না আসলেও ফুটবল টিম ঠিকই খেলে গেছে বাংলাদেশের মাটিতে। মার্কিন রেডএলার্ট জারির পরও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে আগের মতোই নিরাপদ বোধ করছেন। জাপান ও ইটালির নাগরিক হত্যা হলেও সেদেশগুলো রেড এলার্ট জারির বিষয়ে উত্তেজিত মনোভাব দেখায়নি।
বছরজুড়ে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনে কূটনীতিকদের অপতৎপরতার অভিযোগ ওঠে বছরের প্রথম থেকে শেষ অবধি। বছরের শুরুতে হাইকমিশনের ভিসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাযহার খানকে ঢাকার একটি মার্কেট থেকে মজিবর নামে এক জঙ্গিসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল। যদিও পরে হাইকমিশনের হস্তক্ষেপে মাযহার খানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাযহার খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাসহ বড় ধরনের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার অভিযোগও ছিল। এ ধরনের তত্পরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে বছরেরর প্রথমেই পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাযহার খানকে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) পদে কর্মরত ফারিনা আরশাদ নানাভাবে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সহায়তা করছেন এমন অভিযোগ মাথায় নিয়ে বছর শেষে তিনি দেশে ফিরে গেছেন। ঢাকা চায়নি তিনি বাংলাদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করুক এমন তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চরমে উঠে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তান আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ও বিবৃতি দেয়। যার কড়া প্রতিবাদ করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সুজা আলমকে তলব করে প্রতিবাদপত্র দেওয়া হয়। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে পাল্টা তলব করে। এসব বিবেচনায় পাকিস্তানের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার দাবি উঠেছে।
পাকিস্তানি ফেরত বিমানবন্দর থেকেই
ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশের বিমানবন্দরে চলে আসেন পাকিস্তানের এক নাগরিক। তিনি মনে করেছিলেন বিমানবন্দরে নেমেই অন অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের জয়েন্ট ডিরেক্টর আসমা খালিদ (৩৫) শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৪ ডিসেম্বর ভিসা ছাড়াই এসে পড়েন। তাকে বিমানবন্দরের বাইরে বের হতে দেয়নি কর্মকর্তারা। আন্তর্জাতিক একটি সেমিনারে ঢাকায় অংশ নিতে এসে ২১ ঘণ্টা বিমানবন্দরে কাটানোর পর পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
কূটনীতিকের ব্যাগে সোনা
শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সোনা চোরাচালানের একটি প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে। গত ৬ মার্চ ঢাকায় উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে ২৭ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (বাণিজ্য ও অর্থনীতি) সন ইয়াং ও দেশটির কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে কূটনেতিক ছাড় পাবার চেষ্টা করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শিশু রাজন হত্যার আসমিকে ফেরাল সৌদি আরব
সিলেটে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যার অন্যতম আাসামি কামরুল ইসলাম সৌদি আরবের জেদ্দায় পালিয়ে গেলে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাকে ধরে পুলিশের হাতে দেয়। বাংলাদেশ-সৌদি আরবের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। কিন্তু তাকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয় বাংলাদেশ। সৌদি আরবের সরকার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপের ফলে দেশটির আদালত কামরুলকে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়। এ বছরের ৮ জুলাই সিলেটে চুরির অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রাজনকে। এ হত্যার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় সরকার।
ভারত থেকে নূর হোসেন ফেরত
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের আসামি নূর হোসেনকে গত ১২ নভেম্বর ফেরত দেয় ভারত। ২০১৪ সালের এপ্রিলে এ হত্যাকণ্ডের পর পরই নূর হোসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। সেখানকার পুলিশ তাকে আটক করে। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে দেওয়ার একদিন পরই নূর হোসেনকে ফেরত দেয় ভারত। অনুপ চেটিয়া ও নূর হোসেনের হস্তান্তর একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করা হয়। পরে অবশ্য অনুপ চেটিয়াকে ভারতের আদালত জামিন দেয়।