অগ্রদৃষ্টি ডেস্কঃ মুসলমানদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। আনন্দ, উৎসবের সমারোহ ঘটে এ ঈদে। এরই মধ্যে সরকারি ছুটি শুরু হয়ে গেছে। এই সুবাদে পরিবারসহ ঘুরে আসার আদর্শ স্থান চা কন্যার দেশ মৌলভীবাজার। প্রকৃতির নৈসর্গে ভরা এই জেলার চা বাগানগুলোতে যতদূর চোখ যায় মসৃণ সবুজে ছাওয়া উঁচু-নিচু টিলা, উপরে বিস্তৃত নীলাভ আকাশ। সবুজ চা বাগান ছাড়াও এই বৃষ্টি প্রধান অঞ্চলে রয়েছে নজরকাড়া নানা স্থাপনা, প্রকৃতিক নিদর্শন, ধর্মীয় স্থান। চা বাগান, লেক, হাওর, উঁচু-নিচু পাহাড়, ঘন জঙ্গল, খনিজ গ্যাসকূপ আর আনারস, লেবু, পান, আগর ও রাবার বাগান দিয়ে সাজানো অপূর্ব সুন্দর এই মৌলভীবাজার পর্যটকদের থাকার উপযোগী বিভিন্ন মানের হোটেল-রিসোর্ট আছে। নিরাপত্তার জন্য আছে টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশ।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় নবসাজে সাজছে পর্যটন স্পটগুলো। সবুজে ঘেরা চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, পদ্মকন্যার নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ‘ঝর্ণা সুন্দরী’র হামহাম জলপ্রপাতসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ পিপাসু ও প্রকৃতি উপভোগকারী দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। মৌলভীবাজারের নৈসর্গের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসবেন ভ্রমণ পিপাসু বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ। যেসব স্থান দেখার ও উপভোগ করার সেগুলোর মধ্যে অন্যতম চা বাগান: চায়ের জন্য বিখ্যাত সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায়। পাতা আর কুঁড়ির এই দেশ পাহাড় আর চা বাগানে ঘেরা এই জেলা সব সময়ই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক আদর্শ স্থান। ঢাকা-সিলেট সড়কের চা কন্যার স্বাগত জানানো ভাস্কর্য পেরিয়েই সবুজে মোড়ানো শ্রীমঙ্গলের শুরু। এখানে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চা বাগান। অপার এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পশুপাখির বিচরণ নিমিষেই মুগ্ধ করে দেয় চোখ আর মনকে। চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত শ্রীমঙ্গলে গড়ে উঠেছে চা গবেষণা কেন্দ্র। বিটিআরআই (বাংলাদেশ টি রিচার্স ইনস্ট্রিটিউট) ক্যাম্পাসেই রয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন অফিস। ভেতরে ৫০-৬০ বছরের পুরনো চা গাছ সংরক্ষিত। এর প্রাকৃতিক পরিবেশও মনোমুগ্ধকর।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান: শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার অবস্থান। ১৯২০ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে প্লান্টেশন করে তৈরি ধনরাজি এখন ঘন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই পার্কে দেখা মেলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পশুপাখি। এখন এই পার্কটি ধীরে ধীরে দেশের শিক্ষা, গবেষণা, ইকো ট্যুরিজম স্পট হয়ে উঠেছে। শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে অথবা বাসে আপনি আসতে পারেন এ বনে। এখানে আসার পথে রাস্তার দুই ধারে দেখতে পাবেন সবুজ অরণ্য। দেখতে পাবেন বিচিত্র সব পশুপাখি। এসব প্রাণি দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে।
বাইক্কা বিল: বাইক্কা বিল একটি অনন্য স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম এবং জলচর পাখির বিচরণভূমি। এর আয়তন ১০০ হেক্টর। বাংলাদেশের অন্যতম জলাশয় হাইল-হাওরে এর অবস্থান। ২০০৩ সালের ১লা জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে একটি স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। হাওরটি বর্ষায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে ১৩৩টি বিল ও বেশ ক’টি খালে খণ্ডিত হয়ে মোট ৪ হাজার হেক্টর এলাকায় সংকুচিত হয়ে পড়ে। বাইক্কা বিলের প্রধান আকর্ষণ পাখি। সারা বছর বিভিন্ন প্রজাতির জলজ পাখির বিচরণে মুখরিত থাকে এ বিলটি। তবে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য এখানে একটি পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। নয়নাভিরাম এ জলাভূমিতে ফোটে শাপলা, পদ্মসহ নানা প্রজাতির জলজ ফুল।
পশু-পাখি সেবাশ্রম: এক সময়ের সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানার নাম পরিবর্তিত হয়ে এখন হয়েছে বনপ্রাণি ফাউন্ডেশনের পশু-পাখি সেবাশ্রম। সিতেশ রঞ্জন দেবের এই সংগ্রহশালায় রয়েছে সাদা বাঘ, মেছো বাঘ, সোনালি বাঘ, মায়া হরিণ, অজগর সাপ, ভাল্লুক, বানর, লজ্জাবতী বানর, সজারু, সোনালি কচ্ছপ, বনমোরগ, ময়না, বন্য খরগোশ, সাইবেরিয়ান ডাক, পাহাড়ি বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণি।
মাধবপুর লেইক: কমলগঞ্জের মাধবপুর চা বাগানে অবস্থিত মাধবপুর লেইক। লেকের চারপাশে বিশাল টিলায় সারিবদ্ধ ছোট-বড় গাছ আর সবুজ চা গালিচার টিলার মাঝখানে জলরাশি। টলটলে রূপালী জলের সঙ্গে দিবা-নিশির মিতালি করছে নীল পদ্মফুল। জলের আলো ছায়ার নীল পদ্মের লুকোচুরি খেলা মনমুগ্ধ করবে আগত পর্যটকদের। প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজে নিজের রূপ দিয়েই আকর্ষণীয় হয়ে উঠায় জলের পদ্ম কন্যার মায়ায় আকড়ে ধরবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের।
হামহাম জলপ্রপাত: কমলগঞ্জের সীমান্তবর্তী কুরমা সীমান্তের গহীন অরণ্যে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম হামহাম জলপ্রপাত। প্রায় ১৬০ ফুট পাহাড়ের ওপর হতে স্পটটির স্বচ্ছ পানি আচড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের প্রায় ৯ কি.মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাত। প্রায় ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় এই ‘ঝরনা সুন্দরী’র আঙিনায়। রোমাঞ্চকর দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত গহীন বনের ওই ঝর্ণা ধারা। হাইল-হাওর: শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে বৃহত্তর সিলেটের মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত বিখ্যাত হাইল-হাওর।
এই হাওরে শীত মৌসুমে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে বেড়াতে আসে অতিথি পাখিরা। তারা দল বেঁধে হাওরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। এই হাওরে এসে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, অতিথি পাখিদের জলকেলী, আর পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে পাবেন। রামনগর মনিপুরী পাড়া: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে মনিপুর রাজপুরুষ মোয়রাং থেম গোবিন্দের নেতৃত্বে একদল মনিপুরী মনিপুর রাজ্য ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের খাসগাওয়ের রামনগরে এসে আবাস গড়েন। খাসগাওয়ে রয়েছে মোয়রাং থেম গোবিন্দের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ, যা একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।
স্বতন্ত্র কৃষ্টি, সভ্যতা, ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণসমৃদ্ধ এক বৈশিষ্ট্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে আপনিও এই পাড়ায় আসতে পারেন। এখানে আপনি মনিপুরী মেয়েদের তাঁতের কাপড় বুননের দৃশ্য দেখতে পাবেন এবং পছন্দমত শাড়ি, চাদর, ওড়না ইত্যাদি কিনতে পারেন। পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট টুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে জেলা পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে এই কথা জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল।