প্রতারকদের শহরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া লোকটিও নিরাপদ নয়।এরা শত বছর আগের শহরে যেমন ছিল; ঠিক তেমনই এখনো বহাল তবিয়তে।এ যুগে প্রতারণার ধরন পাল্টেছে মাত্র।
সম্প্রতি অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার খবর প্রায়ই শুনা যাচ্ছে।কেউ প্রতারিত হয়ে হচ্ছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত,আবার কেউ প্রতারণা করে হচ্ছেন কোটিপতি।
কখনো আমরা যাকে নথিপত্রে দেখি প্রতারক, বাস্তবে সেই ব্যক্তিই প্রতারিত। আবার যে ব্যক্তি মূল প্রতারক সেই ব্যক্তি অদৃশ্য।
ইদানীং কাতার,ওমান,বাহরাইন, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতে বিভিন্ন পেশার ভিসা পাওয়া যাচ্ছে বলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার চালাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে।
ওই চক্রটি ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ ও কম মূল্যে পাওয়ার বিষয়টি যোগ করায়, সহজ সরল প্রবাসীরা তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেন।
অনেক প্রবাসী ফেসবুক ও ইউটিউবে নতুন ভিসা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেখে “হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু” এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে থাকেন ওইসব ভিসা দাতা চক্রের সঙ্গে। সরাসরি সাক্ষাৎ বিহীন কথোপকথন চলতে থাকে উভয়ের। ভিসা দাতা চক্র তাদের কর্মকাণ্ড প্রবাসীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলার জন্য নিখুঁত কিছু কাজও করে দেখান।
কাজ গুলো যেমন, আরবি ভাষায় কফিল বা নিয়োগকারী ব্যক্তির ভয়েস মেসেজ, ভিসা দাতার পাসপোর্ট কপি, সিভিল আইডি কপিসহ ইত্যাদি নথিপত্র হোয়াটসঅ্যাপে প্রেরণের মাধ্যমে।
সম্প্রতি অনেক কুয়েত প্রবাসীদের কাছ থেকে ঠিক তেমনই অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কুয়েত প্রবাসী সুজন সাজ্জাল, কুয়েতের জাবরিয়া এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন এ প্রবাসী। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, “কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী-Kuwait to bangladesh” নামে ফেসবুকের একটি গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি দেখেন জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তির।
সাজ্জাল বলেন, ওই গ্রুপে প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন ভিসা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। আর তখন থেকে তিনি “হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু” এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে থাকেন জনৈক জাহাঙ্গীর এর সঙ্গে।
নতুন ভিসা পেতে প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলে সাজ্জাল এর কাছ থেকে পাসপোর্ট এর ফটোকপি চেয়ে নেন জনৈক জাহাঙ্গীর। সাজ্জাল যাকে কুয়েতে নিয়ে আসতে চান ওই ব্যক্তির পাসপোর্ট এর কপি পাঠিয়ে দেন জাহাঙ্গীরের হোয়াটসঅ্যাপে।
কিছুদিন অপেক্ষার পর জাহাঙ্গীর নতুন একটি ভিসার ছবি পাঠিয়ে সাজ্জালের কাছে এক হাজার কুয়েতি দিনার দাবি করেন।
জাহাঙ্গীরের কথা অনুযায়ী সাজ্জাল বাংলাদেশের কয়েকটি বিকাশ নম্বরে এক হাজার কুয়েতি দিনার সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা পাঠান।
সাজ্জাল বলেন, তিনি স্থানীয় একজন সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট বা “কুয়েত প্রবাসী সাপোর্ট টিম” এর এডমিন এর সহযোগিতা নিয়ে ভিসা যাচাই করে দেখেন ওই ভিসাটি জাল ভিসা ছিল।
পরে সাজ্জাল এই প্রতিবেদকের শরনাপন্ন হন এবং তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া পুরো বিষয়টি খুলে বলেন।
পরবর্তীতে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে এ বিষয়টি জানানো হলে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন সাজ্জালকে।
আরেকজন প্রবাসী বাংলাদেশী নাম সাঈদ খান তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, জনৈক জাহাঙ্গীর ভিসা দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে এক হাজার কুয়েতি দিনার নিয়েছে।
প্রতারণার শিকার উপরোক্ত দুই প্রবাসীসহ আরো অনেক প্রতারিত প্রবাসীরা জনৈক জাহাঙ্গীরকে কখনো সরাসরি দেখেননি,কথাও বলেননি।ভিসা সংক্রান্ত ব্যাপারে শুধুমাত্র “হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু” এর মাধ্যমেই তাদের কথোপকথন হতো।
কে সেই প্রতারক জাহাঙ্গীর আলম? কোথা থেকে জাহাঙ্গীর অনলাইন ভিত্তিক এই ভিসা প্রতারণা করছে?
প্রবাসী সংবাদকর্মী মহসিন পারভেজ প্রতারণার শিকার প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে জাহাঙ্গীরের দেওয়া তার নিজ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপি নেন এবং খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন জাহাঙ্গীর নামের লোকটিকে।
একসময় কোনোকোনোভাবে পারভেজ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডিধারী জনৈক জাহাঙ্গীর এর সন্ধান পান।
এবার শত প্রশ্নের পর জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে যে জবাব এবং কিছু প্রমাণাদি পাওয়া গেল তাতে বুঝা গেলো যে, এই জাহাঙ্গীর আসলে নথিপত্রে দোষী, বাস্তবে সে একজন অতি সাধারণ প্রবাসী।
অর্থাৎ এবিষয়টি স্পষ্ট হওয়া গেল যে, এই জাহাঙ্গীরের পাসপোর্ট কপি ও সিভিল আইডি কপি ব্যবহার করে ছদ্মবেশী এক জাহাঙ্গীর এসব অনলাইন ভিত্তিক ভিসা জালিয়াতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
কীভাবে এই আসল জাহাঙ্গীরের পাসপোর্ট কপি ও সিভিল আইডি কপি ছদ্মনামধারী ওই জাহাঙ্গীরের হাতে গেল?
এই প্রশ্ন আসল জাহাঙ্গীরকে করা হলে তিনি জানান, প্রায় দুই বছর আগে গৃহকর্মীর ভিসায় কুয়েতে আসেন তিনি। স্থানীয় নাগরিক কফিল দেড় বছর পর তাকে আকামা পরিবর্তন করে অন্যত্র কাজ খুঁজে নিতে বলেন।
পরে জাহাঙ্গীর অনেক খোঁজাখুঁজি করে যখন কোথাও কাজ পাচ্ছিলেন না; তখন তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন এই বলে যে, তাকে যেনো কেউ একটি কাজের সন্ধান দেন।
তখন মনির নামের একজন কুয়েত প্রবাসী হোয়াটসঅ্যাপে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান যে, তার কাছে কাজের সন্ধান আছে। জাহাঙ্গীর অনেক আনন্দিত হয়ে ওই মনিরকে বলেন আকামা পরিবর্তন করতে হলে তাকে কী করতে হবে। মনির জানিয়ে দেন অবশ্যই তাকে বৈধ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডির কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে হবে। জাহাঙ্গীর তাই করলেন, পাসপোর্ট ও সিভিল আইডির কপি পাঠিয়ে দেন।
তারপর, জাহাঙ্গীর আলম কথিত মনিরকে অনেকবার ফোন দেন, আকামা পরিবর্তন বা কাজ সম্পর্কে জানতে চান, কিন্তু মনির কোনো সদুত্তর দেননি।
এদিকে এক সময় এই মনিরই “ছদ্মবেশী জাহাঙ্গীর” হয়ে অনলাইন ভিত্তিক ভিসা প্রতারণা শুরু করেন।
সুজন সাজ্জাল, সাঈদ খান, শামিম, কামাল, খালেদসহ অনেকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভিসা প্রতারণার কাহিনী শুরু করেন জনৈক মনির নামের প্রবাসী।
ওই প্রতারকের নিখুঁত কাজটি ঠিক এরকম যে, কাউকে কাজ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে কৌশলে তার কাছ থেকে নেয়া হয় পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপি। অন্যদিকে,কাউকে ভিসা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হলে,তখন ওই ব্যক্তির কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলার জন্য বৈধ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপি,ভুয়া ভিসা কপি,অজ্ঞাত ব্যক্তিকে নিয়োগকারী বানিয়ে তার ভয়েস সহ ইত্যাদি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়; অর্থাৎ যে পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপিটি কাজ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে কোনো না কোন প্রবাসীর কাছ থেকে নেওয়া হয় সেটি দিয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন ওই প্রতারক।
যেমনটি হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে, জাহাঙ্গীর অতি সাধারণ একজন প্রবাসী, কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে প্রতারক মনিরকে দেন নিজ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপি।
অন্যদিকে, সুজন সাজ্জাল,সাঈদ খান,খালেদসহ অনেকে নতুন ভিসা পাওয়ার আশ্বাসে জাহাঙ্গীকে দেন হাজার হাজার কুয়েতি দিনার “মাধ্যম বিকাশ”।
অনলাইন ভিত্তিক ভিসা প্রতারণা ও কাজের সুযোগ করে দেওয়ার নামে প্রতারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চৌকস প্রতারক ব্যক্তি অজ্ঞাত।
কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস যাকে দেয়া হয়েছে, তার কাছে কথিত প্রতারক মনির নামে পরিচিত।
অন্যদিকে, যাদেরকে ভিসা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়, তাদের কাছে জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত।
একদিকে নথিপত্রে জাহাঙ্গীরকে প্রতারক বানিয়ে জাহাঙ্গীর নামে ছদ্মবেশী প্রতারক ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অন্যদিকে, অর্থ খুইয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সুজন সাজ্জাল, সাঈদ খান,খালেদসহ অনেকে।
প্রতারক একজন “ছদ্মবেশী জাহাঙ্গীর কিংবা মনির”, প্রতারিত দুজন,ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন হলেও ঘটনায় সম্পৃক্ততার যোগসূত্র একই।
ঘটনার আদলে মনে হচ্ছে, কেউ বোকার রাজ্যের অসহায় প্রজা, আবার কেউ প্রতারণায় ভরপুর রাজ্যের নিষ্ঠুর সম্রাট।
এদিকে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান (এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, জি) এর সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বলেন। তখন জানতে চাওয়া হয় ভিসা প্রতারণা বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারের মাধ্যমে অনেকে বলেছে যে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ওরা ভিসা দেবে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, আমি কুয়েত প্রবাসীদের অনুরোধ করবো, আপনারা এরকম প্রচারণা ও প্ররোচনায় পড়ে প্রতারিত হবেন না।
রাষ্ট্রদূত বলেন, যদি কেউ কখনো ভিসা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে, তাহলে আপনারা দূতাবাসে এসে যোগাযোগ করুন,তবেই আমরা তার সত্যতা যাচাই করে পরামর্শ দিতে পারবো। ফেসবুকে ভিসা দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে কেউ যেনো অর্থ লেনদেন না করেন,যোগ করেন রাষ্ট্রদূত।
কুয়েত ও বাংলাদেশ যৌথ নাম ব্যবহার করে কুয়েত থেকে পরিচালিত অনেক ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে বিভিন্ন পোস্ট, বিজ্ঞাপন দেখে সহজ সরল প্রবাসীরা প্রভাবিত হচ্ছেন।
তাই অনেকেই বলছেন, প্রযুক্তির বদৌলতে প্রতারণার ধরন পাল্টে গেছে।এখানে বুদ্ধিমান প্রতারক চক্র,প্রতারিত সহজসরল প্রবাসীরা।
সোনার হরিণ ধরতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশীরা।
কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এর অভিবাসন প্রক্রিয়া বা নিয়মের তোয়াক্কা না করে যারা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন,
তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশীরা বিদেশে এসে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
অন্যদিকে, ভিসা পাওয়া বা নেয়ার ক্ষেত্রেও ভুয়া ভিসা প্রদানকারীদের দ্বারাও প্রতারিত হচ্ছেন সহজসরল প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
সম্পাদকীয়:
অগ্রদৃষ্টি সম্পাদক, আ হ জুবেদ