অগ্রদৃষ্টি ডেস্ক:: বছর ঘুরে আবার ফিরে এলো বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ! স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৩। বাঙালি জনগোষ্ঠী চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা ও বর্ষবরণ উপলক্ষে নানা আয়োজন নিয়ে বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য উৎসবে মেতে উঠবে সারাদেশের মানুষ! টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্রই বর্ষবরণ উৎসবের আমেজ! নববর্ষ উপলক্ষে পাহাড়ী জনপথে বৈসাবী উৎসব শুরু হয়েছে ১২ই এপ্রিল থেকে। বর্ষবরণ উপলক্ষে গত কয়েক দিন থেকেই ব্যস্ত সময় পার করেছে উৎসবমুখী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। নববর্ষের নানা আয়োজন নিয়ে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে চলছে বর্ষবরণের নানা আয়োজন নিয়ে সরাসরি সম্প্রচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
এবার নববর্ষে সরকারি কর্মচারীদের উৎসব বোনাস যোগ হওয়ায় আনন্দে ভাসছে ১৩ লাখ সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তারা। ১৪ই বৃহস্পতিবার হওয়ায় যোগ হয়েছে আরো দুই দিনের ঐচ্ছিক ছুটি এই যেন ঈদের আমেজ।
ঢাকা- চট্টগ্রামসহ দেশের সব বিভাগ ও জেলা-উপজেলা ছাড়িয়ে পহেলা বৈশাখ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। পুরানো বছরের গ্ল্যানিমুছে নতুন বছর, নতুন দিন, নতুন প্রত্যাশায় বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ কে বরণ করবে দেশের মানুষ। পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে ঘিরে বাঙালি জাতির আবেগ আগ্রহ দিন-দিন বাড়ছে। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রাণের উৎসবকে ঘিরে নাটক, কবিতা, আবৃত্তি ও সংগীতের জোর প্রস্তুতি চলেছে গত কয়েকদিন থেকেই।
ঢাকার রমনা বটমূল থেকে চট্টগ্রামের ডিসি হিল, সিআরবি উৎসবে একাকার হয়ে থাকবে সারাদিন! এবার চট্টগ্রামে সিআরবি, শহীদ মিনার, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, পারকির চর ছাড়িয়ে কর্ণফূলীর নদী মোহনায় প্রথমবারের মত ব্যাপক আয়োজনে বর্ষবরণের উৎসব চলবে এছাড়া নগরীর আরো বিভিন্ন স্থানে উৎসবের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সংগঠন তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে নানা বৈচিত্র্যের সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নানা রং এর মুখ ও মুখোশ এবং ফুল, পরী, প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র্য রং তুলিতে তুলে ধরা হচ্ছে! পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছা র্কাড বিতরণে এই বছর ধুম পড়েছে। বসে নেই ঘরের গৃহিনীরাও! পদ্মার ইলিশের আকাল সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ইলিশের খোঁজে গৃহিণীরা ছুটছেন এ মার্কেট থেকে ও মার্কেটে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশের চাহিদা বেড়েছে গত কয়েকদিন থেকেই ফলে ইলিশ যেন এখন সোনার হরিণ! রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাজারে গত কয়েক দিন থেকে দামের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ! যদিও পহেলা বৈশাখের সাথে ইলিশের কোন সম্পর্ক নেই! শহরের নব্যধনিক শ্রেণীর মানুষের অতিমাত্রার ভোগ বিলাসী আয়োজন এখন রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা-উপজেলার নি¤œ মধ্যবিত্ত মানুষের উপর সোয়ার হয়েছে।
যেদেশের সব মানুষের মুখে এখনও খাবার জোটে না, সে দেশে নববর্ষকে কেন্দ্র করে ৪০/৫০ পদের খাদ্য উৎসব ভোগবাদী মানুষের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আবহমান কাল থেকে পহেলা বৈশাখের যে ঐতিহ্য সে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমাদের সবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি ঘরের সৌর্ন্দয বৃদ্ধি এবং বাংলা নববর্ষে নিজেকে নতুন পোষাকে সাজাতে ফ্যাশন হাউস গুলোতে তো ভীড় লেগেই ছিল গত কয়েকদিন থেকেই! মার্কেটে-মার্কেটে শোভা পাচ্ছে বাংলা নববর্ষের নানা রঙের রঙিন পোষাক। ৬ মাসের কোলের শিশু থেকে ৯০ বছরের বৃদ্ধের জন্যও পহেলা বৈশাখের নানা ডিজাইনের জামা কাপড় তৈরি হয়েছে। এ সব জামা কাপড় প্রদর্শনীর উপলক্ষে ফ্যাশন শো হয়েছে অনেক। বাঙালির সবচেয়ে বড় সার্বজনীন এই উৎসব প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ উৎসব প্রিয় এবং অসাম্প্রদায়িক। দেশের ৩ পার্বত্য জেলা জুড়ে নববর্ষ উপলক্ষে বৈসাবী উৎসব পাহাড়ী বাঙালীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে এই নববর্ষ উৎসব।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে নববর্ষ পালন করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন পর্যটকরা কক্সবাজারের দিকে ছুটে আসছেন। এ উৎসব আমেজে দেশীয় সংস্কৃতির আবহমান বাংলার চিরাচরিত ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভিনদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যেন বাংলার নিজস্ব স্বকীয়তা নষ্ট করতে না পারে। কেননা আমাদের রয়েছে আবহমান বাংলার চিরাচরিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাই বিকৃত সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে বাঙালির সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধানে আমাদের জাতিসত্তার আপন মহিমায় উজ্জীবিত হতে হবে। এবারের নববর্ষে ভভু জেলা নিষিদ্ধ হওয়ায় উৎপীড়কদের শব্দ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে আনন্দকামী মানুষের। কিন্তু বিকাল ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রশাসনিক নির্দেশ হতাশ করেছে উৎসব মুখী মানুষকে। বাঙালি সবসময় উৎসবপরায়ণ, কখনো সহিংস নয়। গুটি কয়েক দুষ্ট জনের জন্য লাখো মানুষের প্রাণের উৎসবকে ছোট করে আনার কোন মানে হয়না।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সময় কাল প্রায় ৪৫১ বছরের অধিক পুরানো। ৯৬৩ হিজরী, ২ রবিউস সানী, ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ সালে প্রথম পহেলা বৈশাখ পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। এ রেওয়াজ চালু করেন ঐ সময়ের দিল্লীর স¤্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর।
জানা যায়, হিজরী সনের পরিবর্তে সৌর বৎসর পালনের জন্য ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা সনের প্রথম দিনকে স¤্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর বৃহত্তর কৃষক সমাজের খাজনা আদায়ের জন্য এ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ আয়োজন করেন। মূলত বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে হিজরী সন থেকে। সেই শুরুর পহেলা বৈশাখ কালের পরিক্রমায় বাংলার পথ প্রান্তর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষিদের মাঝে, পৃথিবীর যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীরা রয়েছে সেসব দেশেও আজ পহেলা বৈশাখ পালন করা হবে মহা উৎসবে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে। আবহমান বাংলার চিরাচরিত উৎসব উদযাপনে সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধ হোক বাংলার পথ প্রান্তর।
শুভ হালখাতা
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে স¤্রাট আকবরের আমল থেকে পহেলা বৈশাখে হালখাতার রেওয়াজ চালু আছে। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও বাংলার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও মুদির দোকানদাররা হালখাতার রেওয়াজকে ঐতিহ্যেরআলোকে অক্ষুন্ন রেখেছেন বেশ গর্বের সাথে। হারানো ঐতিহ্যের শৈশবের হাড়ির মিষ্টি পাওয়া না গেলেও বাহারী প্যাকেটজাত মিষ্টি দিয়ে ব্যবসায়ীরা অগ্নিকারী ব্যক্তির মধ্যে দেনা পরিশোধ উপলক্ষে মিষ্টি মুখের আয়োজন করে থাকে।
এ হালখাতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পাওনা আদায় করার মধ্যদিয়ে নতুন বছরে। নতুন প্রত্যাশায় আরেকটি লাল কাপড়ের বাঁধাই করা বিশেষ খাতা খুলে থাকেন। পুরনো খাতার হালনাগাদ ও নতুন খাতার অভিষেক এর মধ্যদিয়ে হালখাতার আয়োজন বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে অস্থিরতা দূর করুক এটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা। এসো মিলি প্রাণের উৎসবে। বাঙালির সংস্কৃতির নানা আয়োজনে বর্ণিল হোক এবারের পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশের মানুষের জন্য বাংলা নববর্ষ বয়ে আনুক অনাবিল সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি। শুভ নববর্ষ ১৪২৩।